সমাজে ও পরিবারে ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপাদান বিয়ে। বিয়ের বহুবিধ কল্যাণ থাকলেও আমরা ক্রমেই বিয়েকে করে তুলছি জটিল। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের সমাজব্যবস্থায় একজন ছেলে চাকরি পাওয়ার আগে পরিবার তাঁর বিয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। কারণ, সেই মুহূর্তে ছেলের ক্যারিয়ার বা বিয়ের সামর্থ্য নেই।
অপরদিকে একজন ছেলের শিক্ষাজীবন শেষ করে ক্যারিয়ার শুরু করতে তাঁর বয়স হয় ২৮ বা ২৯ বছর। ধরা যাক, ছেলেটি ৩০ বছর বয়সে তাঁর বৈবাহিক জীবন শুরু করলেন এবং ৩১ বা ৩২ বছর বয়সে সন্তানের বাবা হলেন। তাঁর প্রথম সন্তান যখন ১৮ বছরের, তিনি তখন মধ্য বয়সে। সন্তানের বয়স যখন ২৮, পিতা তখন ৬০ বছরের প্রবীণ। এ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে সন্তানের সঙ্গে পিতা-মাতার প্রজন্মগত ব্যবধান।
বাবা-সন্তানের এই প্রজন্মগত ব্যবধান আঘাত হানছে উভয়ের মধ্যে বোঝাপড়ায়, যা কখনোই কাম্য নয়। ৬৩ বছর বয়সে পিতা যখন অবসর গ্রহণ করেন, পুত্রের বয়স তখন ৩০। ফলস্বরূপ পরিবারের ছোট সন্তানদের দায়িত্ব পড়ছে বড় সন্তানদের ওপর। যার ফলে আবারও শুরু হয় সেই মানসিক চাপ আর আর্থিক সামর্থ্যের দুষ্ট চক্রের পুনরাবৃত্তি। মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। ফলে পরিবারের ছোট সন্তানেরা মা-বাবার সান্নিধ্য পাচ্ছেন কম, ক্ষেত্রবিশেষে বঞ্চিতই হচ্ছেন।
শিক্ষাজীবন থেকে ক্যারিয়ার শুরুর সময়টায় একজন ছেলে বা মেয়েকে নানা রকম দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, হতাশার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়। তারা এই হতাশা, অনিশ্চয়তা থেকে সাময়িক একটু প্রশান্তি, ভরসা বা নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য ঠুনকো প্রেমের সম্পর্কে জড়াচ্ছে। যা পরবর্তী জীবনে আরও বড় হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই হতাশা থেকে মুক্তির জন্য অনেকেই বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথ।
এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম। মুসলিম বিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দেনমোহর। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ছেলের সামর্থ্য না ভেবে লোকে কী বলবে বিবেচনায় রেখে আকাশচুম্বী দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। যার বেশির ভাগ অংশই ক্ষেত্রবিশেষে পুরোটাই বাকি রাখা হয়। ইসলাম ধর্মে দেনমোহর পরিশোধে বাধ্যবাধকতা থাকলেও, তা যথাযথভাবে আদায় করা হয় কি?
অন্যদিকে যৌতুক যেন বিয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে ইসলামে যৌতুকপ্রথাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছেলেপক্ষ থেকে উচ্চ দেনমোহর এবং মেয়েপক্ষ থেকে যৌতুক আদায়ের জন্য যুবসমাজের মধ্যে বিয়েবিমুখ বা দেরিতে বিয়ে করার প্রবণতা সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি দারিদ্র্যের ভয়ে বিয়েবিমুখ থাকল, সে যেন আল্লাহর ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ করল।’ (সুনানে আবু দাউদ)
বিয়েকে কঠিন করে ফেলার কারণে যুবসমাজ নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এতে পরিবার ও সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে, মানসিকভাবেও অশান্তি তৈরি হচ্ছে। ইসলামি নিয়ম অনুসারে বিয়ে করা একেবারে সহজ অথচ আমরা এটাকে আধুনিক করতে গিয়ে কঠিন পর্যায়ে নিয়ে গেছি। বিয়ে মানেই যেন লক্ষাধিক টাকার রাজকীয় আয়োজন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সাত বছরে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৪ শতাংশের বেশি। এবং এ বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাগুলোর বেশির ভাগ ঘটেছে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। অতএব অর্থনৈতিক দুরবস্থা বৈবাহিক জীবনে অশান্তির মূল কারণ হতে পারে না। বিয়ের জন্য অবশ্যই অর্থের প্রয়োজন, পরিবার চালাতে ন্যূনতম সামর্থ্যবান হতে হয়। কিন্তু বিয়েকে ক্যারিয়ারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলা কোনোভাবে কাম্য নয়। এখানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থারও দায় আছে বলতে হবে।
সামাজিক নিয়মকানুনের দোহাই দিয়ে বিয়েকে বিলম্বিত করা যাবে না। অতিরঞ্জন, মাত্রাতিরিক্ত খরচ, সামর্থ্যের অধিক দেনমোহর, যৌতুক প্রথা এ রকম হাজারো কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনকে মুক্ত করতে হবে। সামাজিকতার নামে এই রাজকীয় বিয়ের আয়োজন বন্ধ হোক।
নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধন ও সামাজিক সুশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বিয়েকে করতে হবে সহজ ও স্বাভাবিক। পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব এবং অভিভাবকদের কর্তব্য সময়মতো বিয়ে করার ব্যাপারে সন্তানদের উৎসাহিত করা এবং বৈবাহিক সম্পর্কের ব্যাপারে সচেতন করে তোলা।
ফাতেমা তুজ জোহরা
গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়