বিল গেটসের সঙ্গে আলাপচারিতা
শিক্ষায় যেভাবে পরিবর্তন আনতে পারে এআই
অনলাইন শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সালমান খান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কীভাবে পড়াশোনার ধরন বদলে দিতে পারে, তা নিয়ে তিনি আলাপচারিতায় অংশ নেন মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের সঙ্গে। ‘আনকনফিউজ মি উইথ বিল গেটস’ শিরোনামের ওই অনুষ্ঠানে প্রচারিত আলাপচারিতাটি ১০ আগস্ট গেটসনোটসে প্রকাশ করা হয়। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তা সংক্ষেপে প্রকাশ করা হলো।
বিল গেটস: আপনি এআই কীভাবে প্রথম ব্যবহার করেছেন? আমি যদি ভুল না করি, মাত্র আপনি খান একাডেমির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শিক্ষক ‘খানমিগো’ সামনে এনেছেন।
সালমান খান: আপনি ঠিকই বলেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন চ্যাটবট চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইর কর্মকর্তারা খান একাডেমিতে এসেছিলেন। এর পেছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, তারা তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন চ্যাটবটকে এপি বায়োলজিতে (যুক্তরাষ্ট্রে কলেজ পর্যায়ের জীববিদ্যা কোর্স) দক্ষ করতে চাচ্ছিল। আরেকটি কারণ আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম। জানি না তা সত্য কি না। তারা আমাকে বলেছিল, আপনি (বিল গেটস) তাদের এ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
বিল গেটস: সেটা ঠিক। ওপেনএআই তাদের চ্যাটবটটি আমাকে বারবার দেখাচ্ছিল। আমি বলেছিলাম, ‘আমার মনে হয় না এটি বাস্তবভিত্তিক। এটি এপি বায়োলজি পরীক্ষায় কেমন করে, তা আপনারা যাচাই করে দেখেন না কেন? যত দিন আপনারা পরীক্ষায় ৫-এ ৫ না পাবেন, তত দিন এদিকে আমি মনোযোগ দিতে চাইছি না।’ পরে অবাক করে দিয়ে তারা আমাকে বলল, ‘আমরা এটি (চ্যাটবট) আপনাকে দেখাতে চাইছি।’ এটি ছিল আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে তাক লাগানো ডেমো (প্রদর্শনের জন্য সফটওয়্যারের যে সংস্করণ তৈরি করা হয়)।
সালমান খান: একেবারে ঠিক। ওপেনএআইকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমার মনে হয়, এটা কাজে লেগেছিল। ওপেনএআই আমাদের কাছে এসেছিল, কারণ খান একাডেমির কাছে এপি বায়োলজির প্রশ্নের বড় সংগ্রহসহ অনেক কিছু রয়েছে। তারা আমাকে এপি বায়োলজির প্রশ্ন দেখিয়ে বলল, ‘এর উত্তর কী হবে?’ আমি বললাম, ‘আমার মনে হয় উত্তর “সি”।’ তাদের চ্যাটবটও জানাল, উত্তর সি। আমি বললাম, ‘ভালো তো।’ তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটি কেন উত্তর হবে, তা জিজ্ঞাসা করুন।’ চ্যাটবটটি তারও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিল।
বিল গেটস: হ্যাঁ, এটা আসলেই ওই কাজে দক্ষ!
সালমান খান: তারপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কি বলতে পারবে, অন্য উত্তরগুলো সঠিক নয় কেন?’ চ্যাটবটটি বলে দিল। আমি উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। আবার বললাম, ‘তুমি কি এমন আরও দশটি প্রশ্ন লিখতে পারবে?’ একে একে সেটি দশটি প্রশ্ন লিখে দিল। দেখলাম, সেগুলো ঠিকঠাকই ছিল। পরে আমরা এটিকে দিয়ে একজন শিক্ষকের কাজ করানোর প্রচেষ্টা শুরু করলাম। পরে আমাদের দল একটি প্রাথমিক মডেল তৈরি করল। এরপর সম্প্রতি আমরা খানমিগো চালু করেছি। মানুষকে এটি ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছি। তাঁরা যে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, তা আশাব্যঞ্জক।
বিল গেটস: আসলেই দারুণ বিষয়।
সালমান খান: আমি মনে করি, এটি খানমিগোর সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর একটি ভালো সুযোগ। কারণ, এটি শুধু কোনো বিষয়ে শিক্ষাদানই করে না, আপনি এটিকে জিজ্ঞাসা করতে পারবেন, কেন ওই বিষয়টি আপনার শেখা দরকার। তখন খানমিগো আপনার কাছে জানতে চাইবে, ‘আপনি কোন বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন?’ আপনি হয়তো বলবেন, ‘আমি এটি কিংবা ওই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।’ এরপর খানমিগো বলবে, ‘আচ্ছা, আপনি যদি এই বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন, তাহলে অবশ্যই আপনার এগুলো জানা প্রয়োজন। পাশাপাশি এখানে আরও কিছু জিনিস রয়েছে, যেগুলো নিয়ে পড়াশোনার বিষয়ে আপনি ভাবতে পারেন।’ সত্যি বলতে কি বেশির ভাগ মানুষের চেয়ে খানমিগো এসব নিয়ে ভালো উত্তর দেবে। ধরুন, এক শিক্ষার্থীর বীজগণিতে সমস্যা হচ্ছে। কারণ, সপ্তম শ্রেণিতে তার এ নিয়ে লেখাপড়ায় কিছুটা ঘাটতি ছিল। এখন একটি শ্রেণিতে ৩০ শিক্ষার্থীর মধ্যে কারও এমন সমস্যা থাকলে তা একজন শিক্ষকের পক্ষে বের করা বেশ কঠিন। কিন্তু খানমিগো বলে দেবে, ‘তোমার কি এখানে ঋণাত্মক সংখ্যাগুলো নিয়ে সমস্যা হচ্ছে? তাহলে এগুলো আবার একটু খতিয়ে দেখো।’ আর আমি খানমিগোর পরবর্তী ধাপ নিয়ে খুবই উতলা হয়ে আছি। খানমিগোকে ভবিষ্যতে শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের মতো কাজে লাগানো যাবে।
বিল গেটস: সব শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করবে?
সালমান খান: হ্যাঁ। মনে করুন, একজন শিক্ষক বললেন, ‘খানমিগো, আমার ৩০ শিক্ষার্থীর ক্লাস নাও। তাদের থেকে তিনজন করে নিয়ে ১০টি দল তৈরি করো। আমি চাই প্রতিটি দল এই সমস্যাটির সমাধান করুক। এরপর শিক্ষার্থীরা সমস্যাটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করুক। তুমি এই কাজে সবাইকে সহায়তা করবে।’ এখন শিক্ষকেরা খানমিগোকে এটাও জিজ্ঞাসা করতে পারবেন, ‘এই সমস্যা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা কী—তা তাদের কাছে জানতে চাও।’ এটি তখন বলতে পারে, ‘এটাই কিন্তু আপনার শিক্ষার্থীরা করেছে। এখানে কিছু উদাহরণ আপনাকে দিলাম। কয়েকজন কিছু বিষয় নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে।’ আমার মনে হয় আপনারা ছয় মাসের মধ্যেই খানমিগোর নতুন সংস্করণ দেখতে পাবেন।
আবার ধরুন, শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়াচ্ছেন বা অন্য কিছু করছেন। আপনি তার কোনো কিছু বুঝতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে আপনাকে শুধু খানমিগোর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। পরে খানমিগো শিক্ষককে জানাবে, ‘তিনজন শিক্ষার্থী আমার কাছে এই প্রশ্ন করেছে। আমি আপনার হয়ে উত্তর দিয়েছি। তারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। এরপরও আপনি বিষয়টি তাদের কাছে আবার ব্যাখ্যা করতে পারেন।’
বিল গেটস: শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি আসলেই মনে করি, পড়া ও লেখায় সফটওয়্যার টুলগুলো অতটাও ভালো নয়। তবে আমার মনে হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একজন ভালো হাইস্কুল শিক্ষকের মতো কাজ করবে। এটি আপনার লেখা বিষয়গুলো মূল্যায়ন করবে। এরপর আপনি বুঝতে পারবেন, কোথায় আপনার ভালো করা দরকার। তবে কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী ঘটাতে যাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন।
সালমান খান: আমরা এতক্ষণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কাজের বাজার নিয়ে যেসব কথা বললাম। তার ভিত্তিতে যদি আপনাকে কোনো অভিভাবক বা শিক্ষার্থীকে পরামর্শ দিতে বলা হয়, কী পরামর্শ দেবেন?
বিল গেটস: আপনাকে আলাদাভাবে আকৃষ্ট করে, এমন কিছু যদি আপনি ভালোভাবে শেখেন, সেটা খুবই ভালো। আমার বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁক রয়েছে। আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংক্রান্ত জিনিসগুলো আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ভাবি। আমাদের এটির দরকার আছে। জলবায়ু নিয়ে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিকভাবে কাজ করা দরকার। ওষুধ নিয়েও কাজের প্রয়োজন আছে। আমার এক সন্তান রাজনৈতিক নীতি ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করতে চায়। আরেক সন্তান চিকিৎসক হতে যাচ্ছে। আরেকজন হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী হতে চায়। তাদের সবাই আলাদাভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। সত্যিকারের স্মার্ট মানুষ যদি রাজনীতিতে আসেন, তাহলে আমার খুবই ভালো লাগবে। জানি, এটি আকর্ষণীয় কাজ নয়, তবে আমি মনে করি, বিজ্ঞান জানা একটি নতুন প্রজন্ম আমাদের দরকার এবং আমাদের মধ্যে যে বিভক্তি, তা কাটিয়ে উঠতে হবে। এ পরিস্থিতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে তরুণেরাই সহায়তা করতে পারে, তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
অনুবাদ: শেখ নিয়ামত উল্লাহ