গেল জানুয়ারিতে চীন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণার পর চীনের বর্তমান জনসংখ্যাবিষয়ক প্রবণতা দেশটির স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে কি না, তা অনেক বিশ্লেষককে ভাবিয়ে তুলেছে।
চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, গত ৬০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো গত বছর চীনের জনসংখ্যা কমতির দিকে এসেছে। যে সময় নাগাদ দেশের জনসংখ্যা কমবে বলে সরকারের তরফ থেকে অনুমান করা হয়েছিল, তার ৯ বছর আগেই তা হয়েছে। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছিল জন্মহার (প্রত্যেক নারীর সন্তান জন্মদানের হার ধরে) ১.৮-এর মধ্যে থাকবে; কিন্তু সেই হার তার চেয়ে অনেক কমে ১.০ এবং ১.১ এর মধ্যে চলে এসেছে। চীন তার এক সন্তান নীতি থেকে সরে ২০১৬ সালে দুই সন্তান নীতিতে আসার পরও দম্পতিদের সন্তান নেওয়ার প্রবণতায় খাড়াখাড়ি পতন দেখা যাচ্ছে। গত বছর সেখানে মাত্র ৯৫ লাখ ৬০ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে। ১৭৯০ সালের পর এটিই সে দেশে সবচেয়ে কম শিশু জন্মগ্রহণের বছর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে ২০২০ সালের আগের করা জনপরিসংখ্যানগুলোর অতিরঞ্জিত ফলাফল চীনের জন্মহারের এই সাম্প্রতিক পতনের চিত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস তৈরি করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৬ সালের একটি নমুনা জরিপে জন্মহার ১.২৫ এবং মোট জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত জরিপে সেই সংখ্যা ১ কোটি ৮৮ লাখ ৩০ হাজার দেখা হয়। একইভাবে চীনের জনসংখ্যাগত অনুমানের বিশ্বস্ত সূত্র হিসেবে স্বীকৃত জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্টাসের (ডব্লিউপিপি) প্রতিবেদনের হিসাব প্রায় প্রতিবারই ভুল প্রতিপন্ন হয়েছে।
ডব্লিউপিপির ২০২২ সালের প্রতিবেদন বলেছিল, চীনের জনসংখ্যা গত বছর থেকে (২০২১ সাল) কমতে শুরু করেছে। অর্থাৎ ২০১৯ সালে তারা চীনের জনসংখ্যা কমতির দিকে যাবে বলে যে সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেছিল, তাদের নিজেদের হিসাবেই সে প্রবণতা সেই সম্ভাব্য সময়ের ১০ বছর আগেই শুরু হয়ে গেছে। অথচ আমি হিসাব করে দেখিয়েছিলাম, চীনের জনসংখ্যা ২০১৮ সালেই কমতির দিকে যাওয়া শুরু করেছিল। ডব্লিউপিপির সর্বশেষ ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হয়েছে চীনের জনসংখ্যা ২১০০ সালে ৭৬ কোটি ৭০ লাখে নেমে আসবে; অথচ তাদেরই আগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ২১০০ সালে চীনের লোকসংখ্যা ১০৬ কোটি ৫০ লাখে পৌঁছাবে।
চীনের নারীদের মধ্যে দেরি করে বিয়ে করা ও সন্তান নেওয়ার প্রবণতা আছে। এতে বন্ধ্যাত্বের হার বেড়ে গেছে। ১৯৮০–এর দশকে যেখানে চীনে বন্ধ্যাত্বের হার ছিল ২ শতাংশ, সেখানেই সেই হার এখন ১৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এ ছাড়া টানা ৩৬ বছর ধরে দেশটিতে এক সন্তান নীতি জারি থাকায় সেখানকার মানুষের মধ্যে এক সন্তান গ্রহণকে স্বাভাবিক বলে মনে হয়ে থাকে। একাধিক সন্তান নেওয়ার মতো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো তৈরি হয়নি।
ডব্লিউপিপির ভবিষ্যদ্বাণী এখনো চীনের জনসংখ্যাকে বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। কিন্তু আদতে তারা যে হিসাব দিচ্ছে তার চেয়ে বাস্তবে চীনের জন্মহার অনেক কম। দুই দশক ধরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জাতীয়তাবাদী প্রচার চালানো এবং দম্পতিদের দুই সন্তান নিতে উৎসাহ দেওয়ার কাজ করলেও সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে কম জন্মহার দেখা যাচ্ছে। এটি চীনের শাসকদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
জন্মহার বাড়ানোর পথে চীনকে বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
চীনের নেওয়া এক সন্তান নীতি দেশটির অর্থনীতির আদলই বদলে ফেলেছে এবং একটি শিশুর লালনপালনের খরচ নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনের হাউসহোল্ড ডিসপোজেবল ইনকাম বা পরিবারভিত্তিক আয় জিডিপির মাত্র ৪৪ শতাংশ যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ৭২ এবং যুক্তরাজ্যের ৬৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, চীনের আবাসন খরচও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি। ২০২০ সালে চীনের আবাসন বাজারের মূল্য ছিল দেশটির জিডিপির চার গুণ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন মার্কেটের দাম তাদের জিডিপির ১.৬ শতাংশ। এ অবস্থায় চীন উভয়সংকটে পড়েছে। যদি এ আবাসন খাতের মূল্য-বুদ্বুদ না ফাটে এবং ফ্ল্যাটের দাম না কমে, তাহলে নবীন দম্পতিরা দুই সন্তান নিতে সক্ষম হবে না। আবার যদি সেই বুদ্বুদ ফেটে যায়, তাহলে চীনের অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে পড়বে।
বাচ্চা প্রতিপালনের খরচের ভয়ে দম্পতিদের সন্তান গ্রহণের অনীহা দূর করতে চীন পাশের দেশ জাপানের অনুকরণে শিশুদের স্কুল ফি কমানো, কম খরচে শিশুপরিচর্যা কেন্দ্র করা, শিশু জন্মদানের জন্য বিশেষ ভাতা চালুর মতো উদ্যোগ নিতে পারে।
চীনের নারীদের মধ্যে দেরি করে বিয়ে করা ও সন্তান নেওয়ার প্রবণতা আছে। এতে বন্ধ্যাত্বের হার বেড়ে গেছে। ১৯৮০–এর দশকে যেখানে চীনে বন্ধ্যাত্বের হার ছিল ২ শতাংশ, সেখানেই সেই হার এখন ১৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এ ছাড়া টানা ৩৬ বছর ধরে দেশটিতে এক সন্তান নীতি জারি থাকায় সেখানকার মানুষের মধ্যে এক সন্তান গ্রহণকে স্বাভাবিক বলে মনে হয়ে থাকে। একাধিক সন্তান নেওয়ার মতো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো তৈরি হয়নি।
এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে চীনে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংখ্যা বেড়ে যাবে। জনগোষ্ঠীর কর্মশক্তি কমবে। প্রবৃদ্ধি কমতে থাকবে। এ অবস্থায় চীন সরকারকে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ইউই ফুজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিদ্যার একজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী