একজন মানুষের নানা রকম শিকড় থাকে। যেমন, রক্তের শিকড়, ধর্মের শিকড় এবং কর্মের শিকড়। আমার মা-বাবা, দাদা-দাদি আমার রক্তের শিকড়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং চার খলিফা আমার ধর্মের শিকড়। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। সেই সূত্রে সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল আমার একাডেমিক শিকড়।
কর্মজীবনেও কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা স্বকীয় গুণে আমাদের কাছে রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁরা হয়ে ওঠেন আমাদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁদের বলা হয় কর্মের শিকড়।
আমার কর্মজীবনে চারজন কর্মগুরু রয়েছেন। তাঁরা আমাকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন, বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়েছেন। তাঁদের কাছে সততা, ন্যায়পরায়ণতা ধারণ-লালন এবং সেবাবান্ধব ও কর্মনিষ্ঠ হওয়ার শিক্ষাদীক্ষা পেয়েছি। পরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও তাঁরা আমার পরম হিতৈষী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
আমার এই চার কর্মগুরু বা চার কর্মের শিকড় হলেন ড. সা’দত হুসাইন, এম এ মান্নান, এম এম রুহুল আমিন ও ম. শফিউল আলম। এম এ মান্নান আমার প্রথম কর্মস্থল কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন। বর্তমানে তিনি পরিকল্পনামন্ত্রী। এম এম রুহুল আমিন ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার প্রথম জেলা ও দায়রা জজ। পরে তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এম এম রুহুল আমিন ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি মারা গেছেন। এম শফিউল আলম কিশোরগঞ্জে আমার দ্বিতীয় জেলা প্রশাসক ছিলেন। তিনিও করোনাকালে গত বছরের ২২ জুলাই মারা গেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁদের জান্নাতবাসী করুন।
তবে আমার চার কর্মের শিকড়ের মধ্যে সবার আগে রয়েছেন সা’দত হুসাইন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় সবার আগে। তাঁর সঙ্গে আমার কর্মকালও সবচেয়ে বেশি। আমি ১৯৮২ সালের ২৭ অক্টোবর বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদানের জন্য তৎকালীন সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে (কোটা) যোগদান করি। সা’দত হুসাইন তখন কোটার জ্যেষ্ঠতম পরিচালক। ফজলুল হাসান ইউসুফ কোটার অধ্যক্ষ বা প্রধান।
১৯৮৩ সালের ২৭ অক্টোবর ছিল বৃহস্পতিবার। তখন কোটায় আমরা নবাগত। ওই দিনই সা’দত হুসাইনের সঙ্গে দেখা হয়। প্রশিক্ষণের পুরো পাঁচ মাসে কোটার সব কাজের কাজি ছিলেন তিনি। আমাদের ভালো কর্মকর্তা হিসেবে তৈরি করতে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দরদ দিয়ে কাজ করতেন। কাজ ছিল তাঁর পেশা ও নেশা। তাঁর কঠোর ও নিবিড় তদারকিতে আমাদের কোটার প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। পরে ১৯৮৪ সালে কোটা বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।
বর্তমানে অনেকেই প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে অনাগ্রহী থাকেন। কিন্তু সা’দত হুসাইন মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে কোটায় চাকরি করেন। তিনি মনে করতেন প্রশিক্ষণ একটি বড় বিনিয়োগ। দেশের অগ্রগতির জন্য সুপ্রশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মী বাহিনীর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন। তাই তিনি পেশা হিসেবে প্রশিক্ষণকেও ভালোবাসতেন। আমৃত্যু তিনি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি দেশের প্রশিক্ষণ জগতের একজন আলোকবর্তিকা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্রশাসনিক কাজেও তিনি ছিলেন এক সুদক্ষ, সাহসী ও সুনামধারী। আমি সাত বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। সর্বত্রই তাঁকে স্বীয় কাজের প্রতি নিবেদিত দেখেছি। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন সৎ মানুষ। বেতনের টাকা ছিল তাঁর জীবিকার একমাত্র উৎস। কাজ ফেলে রাখতেন না। তিনি ছিলেন এক স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব। কারও তদবির শুনতেন না। নিজেও তদবির করতেন না। তাঁর কাজে কারও হস্তক্ষেপ একেবারেই পছন্দ করতেন না। নিজেও কনিষ্ঠ সহকর্মীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতেন না। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সময় আমরা অনেক জনবল নিয়োগ দিয়েছি। কোনো দিন একটি রোল নম্বরের বিষয়েও জানতে চাননি। আবার কোনো কিছুই তাঁর তদারকির বাইরে ছিল না। তাঁর অধিক্ষেত্রে যাতে অন্যরা অন্যায্য কিছু না করতে পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতেন।
সা’দত হুসাইনের স্মৃতিশক্তি ছিল বেশ প্রখর। কাউকে দু-তিনবার দেখলে আজীবন মনে রাখতে পারতেন। নাম বলতে পারতেন। তিনি ছিলেন এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। ১৯৬১ সালের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পুরো পূর্ব পাকিস্তানে গণিত ও ইতিহাসে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই মেধাবী ছাত্র এস এম হলের ১৯৬৬-১৯৬৭ মেয়াদে ছাত্র সংসদে জিএসও ছিলেন।
কর্মজীবনেও ছিলেন সৌভাগ্যের বরপুত্র। যশোরের সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। শেষ করেন সিভিল সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে। দেশের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন এক সুদক্ষ, সৎ, শুদ্ধাচারী কিংবদন্তি সিভিল অফিসার। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান হিসেবেও দেশবাসীর নজর কেড়েছিলেন। সব কর্মস্থলেই ছিলেন একজন সফল মানুষ। ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আমার গুরু ১৯৬৯ ব্যাচের সিএসপি, মুক্তিযোদ্ধা সা’দত হুসাইন এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন গত বছরের ২২ এপ্রিল। তাঁর মৃত্যুর ২২ দিন পর মারা যান তাঁর স্ত্রী শাহানা চৌধুরী। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আমার আবেদন, তাঁদের জান্নাতবাসী করুন।
সা’দত হুসাইনের মতো মানুষদের দৈহিক মৃত্যু হয়, কিন্তু কর্মের মধ্যে তাঁরা বেঁচে থাকেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কর্মবীর সা’দত হুসাইনও তাঁর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন এবং আলো ছড়াবেন।
এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সাবেক সচিব, লেখক ও গবেষক