মুহিত ভাইয়ের হাসিমাখা মুখটাই মনে থাকবে
আমাদের আকাশ থেকে একে একে ঝরে পড়ছে আমাদের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রেরা। আবুল মাল আবদুল মুহিতের ৮৮ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনকে বলতেই হবে মহাজীবন। তিনি আর নেই, এই কথা জেনে শোকবিহ্বল লাগছে, আবার তাঁর হাসিমাখা মুখটা, তাঁর কর্মময় জীবনের নানা সাফল্য, কৃতি আর অবদানের কথা মনে করে শ্রদ্ধা জাগছে।
আবুল মাল আবদুল মুহিতকে আমি ‘ভাই’ বলে ডাকতাম। প্রথম আলোর অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন মুহিত ভাই। তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালে। আমার চেয়ে তিনি ৩১ বছরের বড়, মানে তিনি আবার বাবার বয়সী। তাঁকে ‘স্যার’ বলেই ডাকা সঙ্গত ছিল। আমি মুহম্মদ জাফর ইকবালকে স্যার ডাকি, হুমায়ূন আহমেদ, হাসান আজিজুল হক কিংবা শামসুজ্জামান খানকেও স্যার ডাকতাম। আমার চোখের সামনে আলতাফ শাহনেওয়াজ তাঁদের দিব্যি ‘ভাই’ ডেকেছেন, তা সত্ত্বেও আমি ‘স্যার’ ডাকতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। অথচ, কী আশ্চর্য! এই প্রবীণ, কৃতী, অসম্ভব মেধাবী এবং দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ডাকসাইটে আমলা-সিএসপি অফিসার এবং মন্ত্রীকে আমি ভাই বলে ডাকতাম।
খাতিরটা হলো বোধ করি আমরা যখন ভোরের কাগজে কাজ করতাম, তখন থেকে। তিনি আমাদের কাগজে লিখতেন। প্রথম আলোর শুরুর বছরগুলোয় ৪০ থেকে ৬০ পৃষ্ঠার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা বের হতো, সেটার বিভাগীয় সম্পাদকের ভার এসে পড়ত আমার ওপর, আর তাতে অনিবার্যভাবে একজন লেখকের লেখা থাকত, তিনি হলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাঁর কাছ থেকে লেখা আনা, সম্পাদনার সময় তাঁর সঙ্গে কথা বলা—এসবের মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের নৈকট্য তৈরি হয়।
আর সেই সম্পর্ক প্রগাঢ় হয় তখন, যখন তিনি বইমেলায় আসতেন। যখন তিনি কোনো পদে ছিলেন না, তখন ফেব্রুয়ারিতে তাঁর কাজ ছিল বইমেলায় নিয়মিত হাঁটা। কেডস পরে তিনি হাঁটতেন বইমেলা চত্বরে। আমি যে স্টলে থাকতাম, তাঁর সামনে এলে দাঁড়াতেন। আমার বই কিনতেন। তারপর আবার জোরে হেঁটে চলে যেতেন। দুই দিন পর আবার এসে আমার বইটার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতেন। ‘নিধুয়া পাথার’ নামের একটা উপন্যাসের সংলাপ ছিল রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায়, তিনি বলেছিলেন, ‘আনিস, তোমার এই রংপুরের সংলাপ বুঝতে তো আমার ভারি কষ্ট হয়!’ মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি একইভাবে বইমেলায় আসতেন, হাঁটতেন, সঙ্গে পুলিশ থাকত এবং বই নিয়ে সঙ্গের লোকের ঝোলায় দিয়ে দিতেন।
তাঁর সঙ্গে এক হেলিকপ্টারে উঠে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এলাকায় গিয়েছিলাম, দিরাই। এক বছর আগে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বাসায় গেলাম। বই নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হবে। তাঁর পুত্রবধূ উপস্থাপক। টেলিভিশনের ক্যামেরা আছে। তিনি এসে বসে রইলেন। তাঁর হাতে ‘গুড্ডুবুড়া’র বই দিয়ে তাঁর পাশে বসে রইলাম। তিনি ছিলেন বই-অন্ত প্রাণ। তাঁর বনানীর বাসাটার ছাদে তিনি একটা লাইব্রেরি বানিয়েছেন। বলছিলেন, একটা লিফট বানাচ্ছি। যাতে বাইরের লোক সরাসরি লাইব্রেরিতে যেতে পারে। এই লাইব্রেরি সবার ব্যবহারের জন্য।
আবুল মাল আবদুল মুহিত দীর্ঘদিন ছিলেন অর্থমন্ত্রী, কিন্তু তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগৎ এবং সংস্কৃতিজনের মাথার ওপরে বটবৃক্ষের ছায়া, প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং সরাসরি সহায়তাকারী। তাঁর সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতো বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনে। এই সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে তিনি থাকতেন মঞ্চে আর এরপর মেলারাত ধরে বসে থাকতেন সামনের সারিতে, উচ্চাঙ্গংগীত উপভোগ করতেন। আমি ওই সময় সামনের সারিতে গিয়ে তাঁর হাঁটুর কাছে বসে তাঁর সঙ্গে গল্প করার সুযোগটা কোনো দিনও হাতছাড়া করতাম না। এই রকম বহু ভালো উদ্যোগের পেছনে মুহিত ভাইয়ের আলোকিত হস্তক্ষেপ ছিল, প্রণোদনা ছিল।
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিক উপলক্ষে বছর কয়েক আগে হোটেল সোনারগাঁওয়ে একটা নৈশভোজে সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন মন্ত্রী। তিনি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, প্রথম আলো তো জনমত তৈরিতে নানা ধরনের ভূমিকা রাখে, নানান বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে। বাল্যবিবাহ-শিশুবিবাহ রোধে কি ভূমিকা রাখতে পারে না?
আমাদের সম্পাদক বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের কার্যতালিকায় আছে। আমরা এরই মধ্যে এই বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছোট্ট ভিডিও বানানো হয়েছে, সাত সাহসী। ময়মনসিংহের সাত কিশোরী বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদের নিয়ে। বাল্যবিবাহ রোধ করার যেকোনো ঘটনাকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করি। এরপর মতিউর রহমান ভাই প্রায়ই আমাদের মনে করিয়ে দেন আবুল মাল আবদুল মুহিতের এই ইচ্ছার কথা। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। প্রথম আলোকে ভূমিকা রাখতে হবে।
আসলেই আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে কেন বাল্যবিবাহ কমিয়ে আনতে পারব না? আমরা টিকাদানে সাফল্য পেয়েছি, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে সাফল্য পেয়েছি, খাবার স্যালাইন প্রবর্তন করতে পেরেছি, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতেও পারব। আবুল মাল আবদুল মুহিত ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পড়ে মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে এই একটা বিষয় আমরা অগ্রাধিকার তালিকায় আনতে পারি।
মুহিত ভাইকে সর্বশেষ দেখেছি মুজিব বর্ষের উদযাপন কমিটির একটা ভার্চ্যুয়াল সভায়। মাস তিনেক আগে। তিনি কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ছিলেন। মুজিব বর্ষের উদযাপন কমিটি এবং জাতীয় কমিটি থেকেই যে কতজনকে হারালাম আমরা গত দুই বছরে—আনিসুজ্জামান স্যার, রফিকুল ইসলাম স্যার, শামসুজ্জামান খান, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কবরী...একেকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের আকাশ থেকে ঝরে পড়ল। সর্বশেষ গেলেন মহাজীবনের অগ্রপথিক আবুল মাল আবদুল মুহিত। দেশে-বিদেশে আমলা হিসেবে, অর্থনীতিবিদ হিসেবে যাঁর অবদান অনবদ্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সংগঠক হিসেবে যাঁর অবদান ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে থাকবে আর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে যাঁর ভূমিকার কথা আমাদের মনে রাখতে হবে।
বাংলাদেশ অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ছে।
মুহিত ভাইয়ের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ছে তাঁর নিষ্পাপ হাসিমুখটা। মুহিত ভাইয়ের এই উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় হাসিমাখা মুখটাই আমার হৃদয়ে চিরদিনের মতো গাঁথা হয়ে রইবে। এত বড় মানুষ, আমাদের মতো জুনিয়র ছেলেদের সঙ্গে মিশতেন কী ভীষণ আন্তরিকতাই না নিয়ে।
এই হলো বড় মানুষের বৈশিষ্ট্য। তাঁরা ছোটদের স্নেহ দান করেন, কাছে টেনে নেন। অনুপ্রেরণা জোগান।
মুহিত ভাই, আপনাকে অভিবাদন।