২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ব্যারিস্টার মওদুদ: রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক নির্মোহ পথপ্রদর্শক

জীবদ্দশায় মওদুদ আহমদ ছিলেন কখনো নিন্দিত, কখনো নন্দিত
ছবি : প্রথম আলো

বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কর্মচঞ্চল সক্রিয় এক পূর্ণাঙ্গ জীবন শেষে চলে যান ২০২১ সালের ১৬ মার্চ। সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে ছাত্রজীবন থেকে মওদুদের ভেতর যে কর্মচাঞ্চল্য, তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কীভাবে উজ্জীবিত রেখেছিলেন, সে এক অপার রহস্য আমাদের অনেকের কাছেই। আমরা যখন আশি-ঊর্ধ্ব বয়সে অনেকটা ম্রিয়মাণ, মওদুদ নিজেকে রেখেছিলেন উজ্জীবিত। বয়সের ভারে আমরা যখন ক্রমে নিজেকে গুটিয়ে পরিবারকেই প্রধান আশ্রয় ভাবছি, তখন ওজস্বী মওদুদ তাঁর বুদ্ধিচর্চা, লেখালেখি, রাজনীতি আর দেশভাবনায় খুবই সক্রিয়। মৃত্যুর এক মাস আগেও তেজদীপ্ত ও আবেগপূর্ণ ভাষায় বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিয়েছেন মওদুদ। তাঁর অকস্মাৎ বিদায় বন্ধু, সহযোদ্ধা, অনুসারী আর অনুরাগীদের কাছে এক বেদনার বিষয়। দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতিতে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করে একজন নায়ক বিদায় নিলেন। জীবদ্দশায় যিনি ছিলেন কখনো নিন্দিত, কখনো নন্দিত। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন কী হবে, তা থাকুক আগামী প্রজন্মের হাতেই।

স্কুলজীবনে আগামসিহ লেন আর কায়েতটুলীতে আমরা বেড়ে উঠেছি একসঙ্গে। স্কুলজীবনে পাড়ায় বিভিন্ন নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলায় একসঙ্গে অংশ নিয়েছি। মওদুদ আমার স্কুলজীবন, ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে অত্যন্ত সাহসী আবেগপ্রবণ ও বেপরোয়া ছিলেন। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় মওদুদ ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। এ কারণে নবকুমার ইনস্টিটিউশন থেকে পরীক্ষা দিতে হয় তাঁকে। নবকুমার থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঢাকা কলেজে অধ্যয়নকালে বিভিন্ন আন্দোলনে ও কলেজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে ৯২ (ক) ধারাবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন। ১৯৫৬ সালে আমরা দুজন একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে মওদুদ ও আমি সক্রিয় ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। ছাত্ররাজনীতিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়েছিলাম আমরা।

ব্যারিস্টার মওদুদ যখন সক্রিয়ভাবে বিরোধী রাজনীতি করেন, তখনো তাঁর বাসার ড্রয়িংরুমে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি স্থান পায়। দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এমন অনন্য উদাহরণ ও সাহস কেবল ব্যারিস্টার মওদুদের পক্ষেই হয়তো সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর এমন ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধে অনেকেই তাঁকে ভুল বুঝতেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রচিন্তার সংস্কৃতির বড় অভাব আমাদের দেশে। আমাদের রাজনীতিবিদেরা আত্মজীবনী অথবা রাজনীতিসংক্রান্ত লেখালেখি করেন না বলে তাঁদের মৃত্যুর পর একসময় তাঁরা জনমন থেকে হারিয়ে যান।

মওদুদ তৎকালীন আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠন ছাত্র শক্তিতে যোগদান করে ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় রাজনীতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, ছাত্ররাজনীতিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অঙ্গনে, হল ইউনিয়ন, ডাকসু নির্বাচনসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ডে মওদুদ নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই, যেখানে তাঁর ভূমিকা ছিল না। এই কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মওদুদ সাধারণ ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।

১৯৫৬ সালে আমরা তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। মিসরের প্রেসিডেন্ট কর্নেল জামাল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেন। এ কারণে ব্রিটেন মিসর আক্রমণ করে। ব্রিটেনের মিসর আক্রমণের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়। মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে এক বিক্ষোভ মিছিল সেগুনবাগিচায় ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিস পুড়িয়ে দেয়। সেদিন ব্রিটিশ পতাকা নামাতে গিয়ে মওদুদ আহমদকে পুলিশ বেদম প্রহার করে। পুলিশের প্রহারে মওদুদকে প্রায় অচেতন অবস্থায় রিকশা করে আমি ও সহপাঠী বন্ধু দীনু (দীন মোহাম্মদ) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। এই প্রহারের কারণে মওদুদকে প্রায় তিন মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়।

বন্ধুত্বের সুবাদে ও চিকিৎসার স্বার্থে তাঁকে দেখভাল করার জন্য আমি ছিলাম তাঁর হাসপাতালসঙ্গী। আরেকবার সেই সময়ের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সমাদৃত তালুকদার মনিরুজ্জামানকে অন্যায়ভাবে মাস্টার্স ডিগ্রি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া থেকে বঞ্চিত করায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. নিউম্যান ও তাঁর সমর্থক এনএসএফের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনসহ মওদুদ আহমদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য। এই অপরাধে মওদুদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। ছাত্রজীবন শেষ করে ১৯৬১ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য মওদুদ লন্ডনে যান। লন্ডন যাওয়ার আগপর্যন্ত মওদুদ ছিলেন আমার সার্বক্ষণিক বন্ধু। লন্ডনে গিয়ে মওদুদ প্রেসিডেন্ট আইয়ুববিরোধী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। অল্প সময়ে মওদুদ সেখানেও সে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

১৯৬৬ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে তিনি উদীয়মান ব্যারিস্টার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে মওদুদ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের পোস্টমাস্টার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে মওদুদ কারাবরণ করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ যখন সক্রিয়ভাবে বিরোধী রাজনীতি করেন, তখনো তাঁর বাসার ড্রয়িংরুমে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি স্থান পায়। দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এমন অনন্য উদাহরণ ও সাহস কেবল ব্যারিস্টার মওদুদের পক্ষেই হয়তো সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর এমন ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধে অনেকেই তাঁকে ভুল বুঝতেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রচিন্তার সংস্কৃতির বড় অভাব আমাদের দেশে। আমাদের রাজনীতিবিদেরা আত্মজীবনী অথবা রাজনীতিসংক্রান্ত লেখালেখি করেন না বলে তাঁদের মৃত্যুর পর একসময় তাঁরা জনমন থেকে হারিয়ে যান।

আরও পড়ুন

ব্যতিক্রম শুধু বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান, আলী আহাদ। তাঁরা ছাড়া রাজনীতির লেখাসমৃদ্ধ বইপত্র পাওয়া দুষ্কর। এ ক্ষেত্রে মওদুদ আহমদ ব্যতিক্রম ছিলেন। লন্ডনে প্রবাসজীবন থেকে আরম্ভ করে সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলির অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে তাঁর পর্যালোচনা করে অনেক বই রচনা করেন। তাঁর সমালোচকরাও বলেন যে তিনি যতটা সম্ভব নির্মোহ অবস্থানে থেকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন। একজন লেখক হিসেবে, একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে ব্যারিস্টার মওদুদ তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতাকে বিসর্জন না দিয়ে সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ থাকবার চেষ্টা করেছেন সব সময়। ব্যারিস্টার মওদুদ বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজে, তাঁর লেখায়।

জাকীউদ্দীন আহমেদ ‘স্মৃতি বিস্মৃতির আমি’ গ্রন্থের লেখক, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সাবেক চেয়ারপারসন