১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর আমি অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশীদের কাছে গেলাম পরামর্শের জন্য। তিনি আমাকে গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করতে এবং অ্যালকালি হ্যালিড ক্রিস্টালের ওপর আমার গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে বললেন। একই সঙ্গে আমি হারুন স্যারের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণার জন্য নিবন্ধিত হই। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি থেকে আমি মাসে ৪০০ টাকা বৃত্তি পেয়ে গবেষণা কাজ শুরু করি।
এ সময়ে আমি একটি বড় সমস্যায় পড়ি। ১৯৭৩ সালের শেষে ফজলুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ আমাকে হল ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলেন। আমি হারুন স্যারের সঙ্গে সমস্যাটি নিয়ে আলাপ করি। তিনি কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ফ্ল্যাটে আলাদা একটি ডাইনিং রুম আছে, আমি অনায়াসে ডাইনিং টেবিলটি বারান্দায় সরিয়ে নিতে পারি এবং তুমি সেখানে থাকার ব্যবস্থা করতে পারো। অন্য কোনো শিক্ষক কি তাঁর শিক্ষার্থীর জন্য নিজের ডাইনিং রুম ছেড়ে দেবেন? কখনো না। আমি শেষ পর্যন্ত তাঁর ফ্ল্যাটে উঠিনি। কিন্তু তাঁর কথাটি এখনো আমার কানে বাজছে।
গবেষণা চলাকালে আমি কেবল অ্যাকাডেমিক বিষয় নয়, ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েও তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমি প্রায়ই দেখতাম তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনোয়ারুল আজিম চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর অফিসে বসে আছেন। তিনি ছিলেন হৃদয়বান ও রসিক মানুষ। তিনি আমাকে একদিন বললেন, ‘তুমি জানো, বিকেল পাঁচটার পর কেন আমি অধ্যাপক হারুনের কাছে আসি? আমি তাঁর অফিসে আসি এই ‘জগদ্দলপাথর’কে ঘরে নিয়ে যেতে। তাঁর পরিবার আছে।
এ সময়ে আমি চাকরির জন্য উদ্বিগ্ন ছিলাম এবং বিদেশে বৃত্তি লাভের জন্য চেষ্টা করি। তখন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান নামে নতুন বিভাগ খোলা হয় এবং হারুন স্যার এ বিভাগের চেয়ারম্যান হন। উজ্জ্বল ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাঁর সঙ্গে উদ্যম ও উৎসাহ নিয়ে যোগ দেন (যাঁদের বেশির ভাগই পরবর্তীকালে বিদেশে বড় বড় পদে আসীন হয়েছেন)। এই বিভাগের সব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও একসময় বন্ধ হয়ে যায়। সে সময়ে আমি যুক্তরাজ্যে ছিলাম। আমার ধারণা, বিভাগটি চালু থাকলে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা অনেক দূর এগিয়ে যেত।
১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়ে নতুন কাঠামো তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে আমারও সামান্য ভূমিকা ছিল। একদিন হারুন স্যার আমার অফিসে এসে বললেন, মুজিব শিক্ষক সমিতির সদস্য হিসেবে তুমি ভালো কাজ করোনি। এই নতুন কাঠামোয় যেকোনো অপদার্থ শিক্ষকও পূর্ণ অধ্যাপক হয়ে যাবেন। পরবর্তীকালে উপলব্ধি করেছি, এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কী ভীষণ ক্ষতি হয়েছে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর হারুন স্যার খুবই বিষণ্ন হয়ে পড়েন এবং কিছুদিনের জন্য বিদেশে চলে যান। ১৯৭৬ সালে তিনি ফের দেশে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে আমি কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য দরখাস্ত করি এবং তা অনুমোদনও পায়। ইন্টারভিউ বোর্ডে অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ড. হারুনের সঙ্গে তুমি চমৎকার কাজ করছিলে; কেন পিএইচডি গবেষণা এখানে করছ না। এখানে পিএইচডি করে দেশের বাইরে পোস্ট ডক্টরেট করতে পারতে।
এ সময়ে আমি পিএইচডির গবেষণার পাশাপাশি কমনওয়েলথ বৃত্তির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করছিলাম। একদিন হারুন স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি আমার গবেষণা দাখিল করতে যাচ্ছি। আপনি কি জানেন আমার পরীক্ষক কারা হবেন?’ তার জবাব ছিল—‘এটি অত্যন্ত গোপনীয়। কিন্তু আমি তোমাকে বলতে পারি, পরীক্ষকেরা নামকরা ব্যক্তিই হবেন।’ পরীক্ষক ছিলেন যুক্তরাজ্যর জি আর রিক্কেজেন ও ইতালির এফ ব্যসসানি। হারুন স্যার যাঁদের সঙ্গে কখনো আপস করেননি, অনেক প্রধানই যা সবারটায় করে থাকেন। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম।
১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিস্টলে রওনা হওয়ার আগের দিন আমি হারুন স্যারের সঙ্গে ফের দেখা করি। স্যার আমাকে বললেন, অধ্যাপক জন জাইম্যান (আমার প্রথম তত্ত্বাবধায়ক) তাঁর ক্ষেত্রে খুবই নামকরা ব্যক্তি। সে ক্ষেত্রে তোমার কাজও উঁচুমানের হবে। তিনি আরও বলেন, তুমি এখন তোমার পেশাগত প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় পেলে। যখন ফিরে আসবে তখন আবার একসঙ্গে কাজ করব। ব্রিস্টল থেকেও তাঁর সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ হয়েছে মূলত আমার গবেষণা নিয়ে।
মনে আছে, ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরার আগে আমি হারুন স্যারকে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ও আমার শিক্ষক ড. রফিকুল্লাহ সম্পর্কে জানতে চেয়ে লিখেছিলাম। এই প্রথমবার তাঁর কাছ থেকে কোনো জবাব পাইনি। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে আমি দেশে ফিরে বিভাগে যাই এবং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বা রফিকুল্লাহ স্যার কেউ নেই জানতে পেরে হতাশ হই। কিন্তু হারুন স্যার বিভাগে আছেন জেনে আমি খুশি হই। তিনি প্রথমে যে কাজটি করলেন, তা হলো বিভাগের তত্ত্বাবধায়ককে ডেকে আমার অফিসের জন্য একটি চাবি বানাতে বললেন। আমার আসার আগেই তিনি আমার কাজ ঠিক করে রেখেছিলেন।
এ সময়ে স্যার জানান, ‘আমরা ইতিমধ্যে পিএইচডি গবেষক হিসেবে তোমাকে নিয়োগ দিয়েছি।’ কী মহৎ মানুষ! আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তিনি সেমিনার আয়োজন করাসহ বেশ কিছু দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন। আমার প্রতি কী অগাধ আস্থা তাঁর!
১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে ফেরার পর আমি আবারও আবাসিক সমস্যায় পড়লাম। তখন আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আমাদের থাকার উপযুক্ত ঘর নেই। একদিন হারুন স্যার অধ্যাপক রমজান আলী সরকারের সঙ্গে আমার সমস্যাটি নিয়ে কথা বললেন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। আমি হতাশ হলাম। এরপর একদিন হারুন স্যার বললেন, আমার বন্ধু আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী শহীদুল্লাহ হলের প্রাধ্যক্ষ হয়েছেন, আমি তাঁকে রাজি করিয়েছি তোমাকে হাউস টিউটর হিসেবে নেওয়ার জন্য। আমি হাউস টিউটর হিসেবে নিয়োগ পেলাম এবং আবাসনের ব্যবস্থাও হলো। এটি ছিল আমার জীবনের সন্ধিক্ষণ। যদি সেদিন হারুন স্যার ওই ব্যবস্থা না করতেন, আমাকে বিদেশে চলে যেতে হতো।
১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্যার আমাকে পরামর্শ দিলেন সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করতে। আমি করলাম। কিন্তু ছয় মাসেও কোনো উত্তর এল না। আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। এ সময় হারুন স্যার উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরীকে বেশ শক্ত ভাষায় লিখলেন, দুটি পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের এখনো প্রভাষক পদে থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো নয়। আমি এই চিঠির কথা পরে জেনেছি। ছাত্রের প্রতি একজন শিক্ষকের কী অপরিসীম সহমর্মিতা!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ইতিমধ্যে নীল ও সাদা দলে ভাগ হয়ে গেছে। প্রাধ্যক্ষ চৌধুরীর অনুরোধে আমি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হই। কিন্তু পরদিন দেখলাম প্যানেলে আমার নাম নেই। হারুন স্যারকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘মুজিব, আমিই প্যানেল থেকে তোমার নাম বাদ দিয়েছি। আমি এই নির্বাচন সম্পর্কে ভালো জানি, কিন্তু তুমি জানো না। যদি তুমি নির্বাচনে জিততে না পারো, তাহলে তা তোমার জন্য বিপর্যয়কর হবে।’
১৯৮২ সালের শুরুতে আমি সহযোগী অধ্যাপক পদে দরখাস্ত দিলাম। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়ে নতুন কাঠামো তৈরি করে, চাকরিবিধি অনুযায়ী যেসব প্রবীণ শিক্ষকের পদোন্নতির সুযোগ ছিল না, তাঁদের জন্য এই ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে আমারও সামান্য ভূমিকা ছিল। একদিন হারুন স্যার আমার অফিসে এসে বললেন, মুজিব শিক্ষক সমিতির সদস্য হিসেবে তুমি ভালো কাজ করোনি। এই নতুন কাঠামোয় যেকোনো অপদার্থ শিক্ষকও পূর্ণ অধ্যাপক হয়ে যাবেন। সে সময়ে আমি তাঁর সঙ্গে একমত হইনি। কিন্তু পরবর্তীকালে উপলব্ধি করেছি, এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কী ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। আজ দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই অধ্যাপক।
অধ্যাপক হারুন অর রশীদ ছিলেন মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বই: আইনস্টাইন ও আপেক্ষিক তত্ত্ব; বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান, কম্পিউটারের কাহিনি, চিরায়ত বলবিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন, ফিরে ফিরে দেখা আমাদের মহাবিশ্ব, আধুনিক নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান; নোবেল বিজয়ী আবদুস সালাম আদর্শ ও বাস্তবতা। এ ছাড়া ইংরেজিতেও বিজ্ঞানবিষয়ক অনেক মৌলিক বই লিখেছেন তিনি।
শিক্ষক হিসেবে হারুন স্যার যে কতটা দৃঢ় চরিত্রের ছিলেন, একটি ঘটনা উল্লেখ করলে তা স্পষ্ট হবে। আশির দশকের শুরুতে একদিন তিনি তাঁর অফিসে কাজ করছিলেন। এরই মধ্যে এক দল শিক্ষার্থী (বহিরাগতও হতে পারে) তাঁর কক্ষের দরজার সামনে এসে উচ্চ স্বরে বলছিলেন, ‘আমাদের লোকদের কাজ না দিলে আমরা আপনার অফিস সংস্কার করতে দেব না।’ আমার ধারণা তাঁরা ছিল ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ক্যাডার, যাঁরা ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করেছেন। স্যার তাঁদের পাল্টা ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোমরা আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাও।’[ স্যারের পাশে অধ্যাপক শামসুল ইসলাম হারুন বসা ছিলেন। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার কথা বললেন। কিন্তু হারুন স্যার জবাব দিলেন, ‘যদি এই ছেলেগুলো আমার অফিসের ভেতরে ঢুকতে চায় তাহলে আমার লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে।’ এই ছিলেন হারুন স্যার। অথচ আজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে দেখি এ ধরনের ছাত্রদের তোয়াজ করতে।
সমাজের প্রতি হারুন স্যারের ছিল অপরিসীম দায়বদ্ধতা।
তিনি তাঁর মেধা ও সৃজনশীলতাকে কেবল ক্যাম্পাসে সীমিত রাখেননি, বৃহত্তর সমাজকে বিজ্ঞানচর্চা ও শিক্ষায় উজ্জীবিত করতে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি পরিষদ গঠন করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম (জীববিজ্ঞান), ওয়াহিদুল হক, আলী আসগর, সন্তোষ গুপ্ত, আবদুল হালিমের মতো ব্যক্তিরা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
অধ্যাপক হারুন অর রশীদ ছিলেন মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বই: আইনস্টাইন ও আপেক্ষিক তত্ত্ব; বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান, কম্পিউটারের কাহিনি, চিরায়ত বলবিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন, ফিরে ফিরে দেখা আমাদের মহাবিশ্ব, আধুনিক নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান; নোবেল বিজয়ী আবদুস সালাম আদর্শ ও বাস্তবতা। এ ছাড়া ইংরেজিতেও বিজ্ঞানবিষয়ক অনেক মৌলিক বই লিখেছেন তিনি।
এই মহান শিক্ষক ও বিজ্ঞান সাধকের প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এস এম মুজিবুর রহমান অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সুলতান কাবুস ইউনিভারসিটি (ওমান)