অসীমের পানে যাত্রা করলেন গণমানুষের বিপ্লবী ফুটবলার। হৃদয় থমকে দেওয়ার মতো এক সংবাদ। ফুটবল ইতিহাসের বিস্ময়কর এই অমিত প্রতিভাবান জাদুকরের প্রয়াণে শোকাচ্ছন্ন সারা বিশ্ব। ম্যারাডোনা দু পায়ের জাদুতে মাত করেছিলেন ফুটবলপ্রেমীদের। অসাধারণ শৈলী দিয়ে তিনি নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের ম্যারাডোনায় পরিণত হয়েছিলেন। ফুটবলের আঙিনা ছাড়িয়ে তিনি ছিলেন সাধারণের ম্যারাডোনা।
আমাদের দেশেও ম্যারাডোনার কোটি কোটি ভক্ত রয়েছেন। অন্য কোনো খেলোয়াড় ম্যারাডোনার মতো একই সঙ্গে জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি পেয়েছিলেন কি না, বলা মুশকিল। ম্যারাডোনা সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন স্বভাব, চরিত্র ও বৈচিত্র্যে।
ম্যারাডোনা সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন। ফুটবল, রাজনীতি, সমাজজীবন—সব জায়গাতেই তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। কখনো পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মন্তব্য করে। কখনো মাদক সেবন করেছেন, সাংবাদিকদের রাইফেলের গুলি করে তাড়া করেছেন। কখনো নারীপ্রীতির কারণে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে একাই বিশ্বকাপ জিতিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেন। তাঁর মতো একক কৃতিত্বে দলকে টেনে নেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন খেলোয়াড় যুগে যুগে আসে না।
ম্যারাডোনার চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি কখনোই বিশ্ব মোড়লদের মোসাহেবি করেননি। চাটুকারিতা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য না। যদিও বিতর্ক ম্যারাডোনার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। যেখানেই গেছেন, বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।
আরেকজন ম্যারাডোনার জন্য হয়তো আমাদের কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হতে পারে। এই ধরনের জাদুকরি প্রতিভা সব সময় জন্ম নেয় না। ম্যারাডোনা ছিলেন বিরল প্রতিভার এক মোহনীয় ফুটবলার। দু পায়ের কারুকার্যে সম্মোহিত করেছেন সবাইকে।
আর্জেন্টিনার ফুটবলকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে অন্য কোনো আর্জেন্টাইন আর পৌঁছাতে পারেনি। আর পারবে বলেও মনে হয় না। ক্লাব ফুটবলেও তিনি সমানভাবে সফল। ইতালিতে খেলতে এসে নাপোলির মতো এক অখ্যাত ক্লাবকে সাফল্যের শিখরে নিয়েছিলেন।
ম্যারাডোনার চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি কখনোই বিশ্ব মোড়লদের মোসাহেবি করেননি। চাটুকারিতা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য না। যদিও বিতর্ক ম্যারাডোনার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। যেখানেই গেছেন, বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি হাত দিয়ে গোল দিয়ে বলেছিলেন, ওটা ছিল ঈশ্বরের হাত। কিন্তু তিনি তো ফুটবলেরই ঈশ্বর। ওই গোলের পরই ছয়জনকে কাটিয়ে এক দুর্দান্ত গোলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন। পায়ের ভেলকিতে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন সব বিতর্ক।
নারী নিয়েও ম্যারাডোনা একাধিকবার গল্পের জন্ম দিয়েছিলেন। দুবাইয়ে গত বছর নিজ বান্ধবীর বিরুদ্ধে হীরার অলংকার চুরির অভিযোগ করেন। পরে তদন্তে দেখা যায়, ওই বান্ধবী অলংকারটি চুরি করেননি। মৃত্যুর আগে আগেও তিনি মাদক নিরাময়কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন মাদক গ্রহণের দায়ে।
ম্যারাডোনা আর দশজন লাতিন আমেরিকার ফুটবলারের মতোই সহজাত ছিলেন। জীবনাচারেও খুব বেশি ব্যতিক্রম ছিলেন না অন্যদের থেকে। মাদক, নৈশ ক্লাব, নারী—সব মিলিয়ে তিনি অন্য লাতিন খেলোয়াড়দের মতোই লাগামহীন জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন।
সব মিলিয়ে ম্যারাডোনা লাতিন আমেরিকার এক সাধারণ চরিত্রের ভিন্নমাত্রা। বস্তি থেকে উঠে এসে ফুটবল-জাদুতে সবাইকে মোহিত করবেন, সঙ্গে থাকবে উদ্দাম জীবনযাপন। কিন্তু সাধারণের ভিড়ে কেউ কেউ ব্যতিক্রম হয়ে থাকেন। ম্যারাডোনা তেমনই এক ব্যতিক্রমী খেলোয়াড়। তিনি ছিলেন অনেকের থেকে ভিন্ন। তাঁর ভিন্নতা কোথায়?
তিনিই সম্ভবত উপনিবেশ-উত্তর কালে হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম খেলোয়াড়, যিনি কিনা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছিলেন। ম্যারাডোনাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। তাঁর মধ্যে অসংগতিও ছিল বিস্তর। কিন্তু তিনি নিজেকে বিকিয়ে দেননি। ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হাত দিয়ে গোল দিয়েও তিনি দারুণভাবে নন্দিত ও সমাদৃত। তখনো ফকল্যান্ডের যুদ্ধের দগদগে স্মৃতি বহন করছে আর্জেন্টাইনরা। ওই মুহূর্তে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মোহনীয় ফুটবল জাদু তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।
উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধীরা মনে করেন, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যেকোনো পর্যায়ে জয় মানেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। ম্যারাডোনা সেই লড়াইয়ে রসদ জুগিয়েছেন। তিনি বিপ্লবী চে গুয়েভারার সমর্থক ছিলেন। তাঁর বাহুতে চে-র উলকি আঁকা ছিল। পায়ে ছিল ফিদেলের উলকি। তিনি কিউবার বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু ছিলেন। ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পরই তিনি ১৯৮৭ সালে কাস্ত্রোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভেনেজুয়েলার হুগো চাভেজের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর সঙ্গেও তাঁর সখ্য ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। গত বছর বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তারা বিশ্বের মোড়ল। তাদের কাছে সব থেকে বড় বোমা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভান করে, আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তারা পারবে না।’ আর কোনো খেলোয়াড় এতটা সাহসের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এমন খোলামেলা কথা বলেননি।
ম্যারাডোনার চরিত্রের এই ভিন্নতা তাঁকে উপমহাদেশে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। বিশেষ করে আমাদের দেশে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয় এক ফুটবল তারকা। ভিন দেশি অন্য কোনো তারকাকে নিয়ে এত মাতামাতি হয়নি, যতটা হয়েছে ম্যারাডোনাকে নিয়ে।
বিশ্বের অনেক তারকা খেলোয়াড়ই ছিলেন তাঁর সমসাময়িককালে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ম্যারাডোনার মতো প্রতিবাদী আচরণ অনুপস্থিত ছিল। অনেকেই জনপ্রিয়তার সুযোগে ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করেন। আপস করেন। কেউ কেউ অবৈধ নির্বাচনে সংসদ সদস্যপদে নির্বাচনও করেন। কিন্তু ম্যারাডোনার নিজের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিবাদী এক চরিত্র গঠন করতে পেরেছিলেন। বুয়েনস এইরেসের বস্তি থেকে উঠে আসা ম্যারাডোনা নিজেকে খেলার বাইরেও নিয়ে গেছেন। বিশ্বকে পুরেছিলেন হাতের মুঠোয়। জনপ্রিয়তা, খ্যাতি এক বিশাল দায়িত্ব। সবাই দায়িত্ব সামলাতে পারেন না। তিনি এখানে সফল।
ম্যারাডোনার চরিত্রের এই ভিন্নতা তাঁকে উপমহাদেশে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। বিশেষ করে আমাদের দেশে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয় এক ফুটবল তারকা। ভিন দেশি অন্য কোনো তারকাকে নিয়ে এত মাতামাতি হয়নি, যতটা হয়েছে ম্যারাডোনাকে নিয়ে। তিনি সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। কখনো ফুটবল দিয়ে। কখনো তাঁর রাজনৈতিক আচরণ দিয়ে।
ফুটবলের এই খেয়ালি প্রতিভা নিজেকে তিলে তিলে হত্যা করেছেন। অনেকেই বলেন, তিনি ধীরে ধীরে আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবারই মাদক নিরাময়কেন্দ্র থেকে বের হয়ে নতুন নতুন মাদকে আসক্ত হয়েছেন। প্রথাগত লাতিন আমেরিকান চরিত্র থেকে তিনি বের হতে পারেননি। তিনি কখনো ফুটবলের জাদুকর, কখনো মাদকসেবী, কখনো প্রতিবাদী বিপ্লবী। দক্ষিণ আমেরিকান চরিত্রের সব উপাদানই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। ব্যক্তিজীবনে ম্যারাডোনা সুশৃঙ্খল ছিলেন না। কিন্তু তিনি খ্যাপাটে জীবন দিয়েই বৈশ্বিক বিশৃঙ্খল রাজনীতিতে পরিবর্তনের আশা করেছিলেন। তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তবে খেলোয়াড়ি ইমেজ দিয়েই পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। তিনি জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেননি। বরং তিনি এক অনবদ্য বর্ণময় জীবন যাপন করেছেন।
ম্যারাডোনাদের মৃত্যু হয় না। অনন্তলোকে থেকেও তাঁর ফুটবলপ্রতিভা দিয়েই জীবন্ত থাকবেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থানের জন্যও নন্দিত হবেন। এখানেই ম্যারাডোনা ব্যতিক্রম। তিনি সাফল্যের মুকুটে ফুটবলের পাশাপাশি অন্যান্য পালকও যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। মানুষ অবশ্যই একসময় অতীত হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর কর্ম ও কৃতিত্ব থেকে যাবে এই নশ্বর পৃথিবীতে। এ জন্যই তাঁর মৃত্যুতে বুয়েনস এইরেসের অ্যাটর্নি মন্তব্য করেছেন, ম্যারাডোনার জীবনে নানা উত্থান-পতন আছে। কিন্তু দিন শেষে যদি সব হিসাব-নিকাশ করি, তবে শেষ পর্যন্ত ম্যারাডোনাকে ক্ষমা করে দিতে হবে। তিনি থাকবেন হৃদয়ের মণিকোঠায়।
উচ্ছৃঙ্খল জীবনের ভেতরেও তিনি মহান। ম্যারাডোনা ছিলেন গণমানুষের এক বিপ্লবী ফুটবলার। ফুটবলের অভিজাত সারির সদস্য হয়েও তিনি সাধারণের কাতারে নেমে এসেছিলেন। জনপ্রিয়তায় তিনি বিটলস, মোহাম্মদ আলী, নেলসন ম্যান্ডেলা বা ইয়াসির আরাফাতের পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। বিশ্বের শোষিত নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর ছিলেন ম্যারাডোনা। এখানেই তিনি অনন্য ছিলেন। বিদায় গণমানুষের বিপ্লবী ফুটবল-ঈশ্বর ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক