আশির দশকের শেষ দিকের কথা। আমি তখন আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ইনস্টিটিউট অব কম্পিউটার সায়েন্সে কাজ করি। সপ্তাহে একবার করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, কখনো কম্পিউটার সেন্টারে ঢুঁ মারি।
একদিন লিফটে উঠেছি, হাতে রুশ ভাষায় লেখা দি আর্ট অব কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের একটি খণ্ড। সবুজ মলাটের বড় বইটি দেখেই বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার এক সহযাত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, বইটি ডোনাল্ড কানুথের লেখা কি না।
রাশিয়ায় যারা পড়ালেখা করেছে, তারা আমার প্রায় সমবয়সী, সবাইকেই আমি কমবেশি চিনি; আর আমার থেকে ১০–১২ বছর সিনিয়র কোনো ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষালাভের জন্য সেখানে গেছে, এমন তথ্যও আমার অজানা। বুঝতে পারলাম, ভদ্রলোক রাশিয়াতে পড়ালেখা করেননি, তাহলে অন্তত দু–একটি রুশ শব্দ কিংবা বাক্য উচ্চারণ করতেন।
অথচ রুশ না জেনে বইয়ের মলাটে যে বর্ণগুলো আছে, তা থেকে দি আর্ট অব কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কিংবা ডোনাল্ড ই কানুথ শব্দগুলো অনুমান করা অসম্ভব। তাই আশ্চর্য হলাম। জেআরসির নাম শুনলেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ তখনো হয়নি, এইবার হলো।
এই হলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার। কী থেকে কী তথ্য বের করে আনলেন। সামান্য পর্যবেক্ষণ থেকে এই ধরনের অনুমান করার ক্ষমতা শুধু প্রতিভাধরদেরই থাকে।
বিপরীতধর্মী অসংখ্য সভায় সভাপতিত্ব করেছেন জামিলুর রেজা চৌধুরী, সভা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ব–উদ্যোগে মুহূর্তের মধ্যে সব সদস্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। স্যারের পরিচিত মানুষের সংখ্যা যত, মিশেছেন তার থেকে ঢের বেশি মানুষের সঙ্গে। একবার যাকে দেখেছেন, কখনোই তাকে ভোলেননি; নাম, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য শুধু মনেই রাখেননি, প্রয়োজনের সময় কাজেও লাগিয়েছেন।
বিভিন্ন সময়ে সিলেকশন বোর্ডে স্যারের সঙ্গে বসার সুযোগ হয়েছে আমার। তিনি প্রার্থীর প্রকাশনার তালিকা দেখেই বের করে ফেলেছেন তাঁর স্বামী বা স্ত্রীর নাম, কখনো কখনো বাবা–মায়ের নাম পর্যন্ত। জীবনবৃত্তান্তের অসংগতি পাতা ওলটাতে ওলটাতেই ধরে ফেলতেন। স্যারের শিক্ষকতা ও গবেষণার ক্ষেত্র ছিল পুরকৌশল, অথচ কম্পিউটার বিজ্ঞানের বড় কোনো আবিষ্কারই তাঁর নজর এড়াত না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ বিজ্ঞানীদের অর্জনও সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নজরে আসত।
২০০৫ সালে বেশ কিছু সময়ের জন্য আমাকে দক্ষিণ কোরিয়ায় যেতে হয়েছিল। যাওয়ার আগে আগে এক রাতে আমার স্ত্রীর বুকে ব্যথা ওঠে। কাছেই বারডেম, তাকে সেখানে নিয়ে যাই। কর্তব্যরত চিকিৎসক ছাত্রজীবনে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছিল, সেই সুবাদে আমাকে চিনল এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিল।
পরদিন সকালে স্যারের সঙ্গে দেখা। সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে বারডেমের ডিজিকে ফোন করে বিষয়টি জানালেন। চিকিৎসায় যাতে কোনো ত্রুটি না হয়, তার অনুরোধ করলেন।
আমি আশ্বস্ত হলাম। তারপর স্যার বলা শুরু করলেন, বর্তমান ডিজি আগে কোথায় ছিলেন, তারও আগে কোথায় ছিলেন, আর আগের ডিজিই–বা এখন কোথায় আছেন। মুহূর্তের মধ্যে কত রকম তথ্য যে বলে দিলেন।
স্যারের মতো বিচক্ষণ আর ধীশক্তিসম্পন্ন মানুষ যদি অসম্ভব স্মৃতিধর হয়, তখন তার কাজের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায় শতগুণ। সংশ্লিষ্ট বিদেশি বিশেষজ্ঞের জীবনবৃত্তান্তে দাবি করা সাফল্যের বয়ান ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে যমুনা সেতুর ফাটলের ক্ষতিপূরণের বিষয়টির সঙ্গে সংযুক্ত করেন।
কী মাপের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব থাকলে একজন মানুষ ওয়েব ব্রাউজিং করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিষয়ের কার্যকর সমাধান খুঁজে পান। সব বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও গাড়িতে বসে সুডোকু মিলানোর মতো কঠিন কাজ করতেন নিয়মিত। দেশ-বিদেশের সব প্রয়োজনীয় খবর বের হতো তাঁর মুখ থেকে যথাযথ প্রসঙ্গে।
আমাদের পুরকৌশল ভবনটি জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের নামে রাখায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আমি সাধুবাদ জানাই। আশা করি স্থাপত্যের আইনস্টাইনখ্যাত এফ আর খানসহ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যশস্বী কীর্তিমান স্নাতক, অধ্যাপক, গবেষক এবং প্রকৌশলীদেরও যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বদরবারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো