রাজনীতির সঙ্গে স্থানীয় ভূপ্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর গভীর সম্পর্ক থাকে। রাজনীতি কেবল মাঠে–ময়দানে বক্তৃতা বা রাজপথে মিছিল না। রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মসূচিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের জন্য উপরিউক্ত বিষয়গুলোকে গভীরভাবে বিবেচনা করতে হয়।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশেষভাবে এ বিষয়গুলো পরিলক্ষিত হয়। জিয়াউর রহমান স্বল্প সময় রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে তিনি দেশের মাটি, পানি, পরিবেশকে অক্ষত রেখে অর্থনীতি, উন্নয়ন ও নাগরিক জীবনকে একসুতোয় গেঁথেছিলেন।
আমরা এখন টেকসই উন্নয়নের কথা বেশ গুরুত্ব দিয়েই বলি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগেই জিয়াউর রহমান টেকসই, পরিবেশবান্ধব উন্নয়নদর্শন বাস্তবায়ন করেছিলেন।
জিয়াউর রহমানের ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে বিপথগামী একদল সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন জিয়াউর রহমান।
রাষ্ট্রনায়কেরা বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে জনসাধারণের মনে আসন তৈরি করে নেন। জিয়াউর রহমানের অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি নন্দিত হয়েছে। আবার নিন্দামন্দও কম করা হয় না।
এসবের পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, ঝড়, তুফান, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির এই সময়ে জিয়াউর রহমানের পরিবেশ ও জলবায়ুবান্ধব উন্নয়নদর্শন বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে।
তিন দিন আগেই উপকূলে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এর প্রভাবে টানা বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টিতে রাজধানীসহ চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার দৃশ্য আমরা দেখেছি। আমাদের নগরগুলো একটু বৃষ্টি হলেই জলাধারে পরিণত হয়। আশপাশে পানি নামার কোনো সুযোগ নেই। ক্রমশই খাল–বিলগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
কয়েক দিন আগেই তাপপ্রবাহে জনজীবনে নেমে এসেছিল বিপর্যয়। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে তাপমাত্রা যেমন বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে গাছপালাও উজাড় হয়ে যাচ্ছে। তাপপ্রবাহের কারণে অনেকেই গাছ লাগানোর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু আমরা যদি পরিবেশ ও জলবায়ুর কথা বিবেচনা করে উন্নয়ন পরিকল্পনা নির্ধারণ করে কঠোরভাবে অনুসরণ করতাম, তবে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। দুঃখজনক হলেও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ননীতি আমরা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, নির্ধারণই করতে পারিনি।
কাগজে–কলমে অনেক কথাই হয়তো বলা আছে কিন্তু আইনের ফাঁকও আছে। যে কারণে আমরা বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় ডুবে যাই বা গরমে পুড়তে থাকি। জলাধারগুলো ভরাট হয়ে গেছে। আর নগরগুলো জলাধারে পরিণত হয়েছে।
অথচ জিয়াউর রহমান ৪৫ বছর আগেই জলাধার নির্মাণেরই কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। এই দিক থেকে বিবেচনা করলে জিয়াউর রহমান পরিবেশ ও জলবায়ুবান্ধব উন্নয়ননীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন।
শাসক বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমানকে বিভিন্নভাবে বিবেচনা করা যায়। জিয়াউর রহমান সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তিনি সামরিক বাহিনী থেকে এসে ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন। সেই অর্থে তিনি প্রথাগত রাজনীতিবিদ নন।
ওই সময়ে বিভিন্ন দেশেই সামরিক বাহিনীর লোকজন ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে খুব বেশি শাসক জনপ্রিয় হতে পারেননি। জিয়াউর রহমানকে নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রবল সমালোচনা ও আপত্তি আছে। এ নিয়ে বিস্তর আলাপ–আলোচনা হয়েছে পক্ষে ও বিপক্ষে।
তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়াউর রহমান অনেক দক্ষ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদেরও ছাপিয়ে গিয়েছেন। এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে সার্বিকভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন সর্বত্র। তবে এ ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত নির্মম ছিলেন বলে তাঁর প্রতিপক্ষ সমালোচনা করে।
কিন্তু এটাও অনেকে বলে থাকেন, তিনি দেশকে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র তিনি ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাকশালে বিলীন হওয়ার পর তাঁর শাসনামলেই আওয়ামী লীগ নিজ নামে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসে।
জিয়াউর রহমানের সময়ই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। আবার জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীকেও রাজনীতির সুযোগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়।
পরিবেশবান্ধব মধ্যবাম ধারার টেকসই উন্নয়ননীতি জিয়াউর রহমানকে বাস্তবিক অর্থেই মাঠের মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি মাঠে, খালে, বিলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেলেন। একসঙ্গে খাল কাটলেন। পাশাপাশি বসে আহার করলেন। এটাই মূলত জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান এখন কোথাও নেই এক অর্থে। গণমাধ্যম, বই, পুস্তক, গান, কবিতা বা সিনেমায় জিয়াউর রহমানের উপস্থিতি নেই।
জিয়াউর রহমানের অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়। ওই সময় দেশে সামাজিক গণতন্ত্রী বা মধ্যবাম ধারার রাজনীতির বিকাশ ঘটান জিয়াউর রহমান। আমরা যদি বিএনপির ১৯ দফাসহ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচিগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করি, তবে মধ্যবাম ধারার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
প্রথমত, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাতিবাদী বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ধারা প্রবর্তন করেন তিনি।
রাজনীতিতে সব দলের অংশগ্রহণের পাশাপাশি বাকশাল আমলের কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত নীতির পরিবর্তে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা করেন। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হয় এতে।
তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল। এসবের সঙ্গে পরিবেশ ও জলবায়ুবান্ধব উন্নয়ননীতি গ্রহণ করেন। তখন বিশ্বে কেবল পরিবেশ রক্ষার আলাপ শুরু হয়েছে। ১৯৭২ সালে সমুদ্রদূষণ বন্ধে কনভেনশন গৃহীত হয়েছে লন্ডন সম্মেলনে। ১৯৭৯ সালে স্টকহোমে প্রথম পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সময় মধ্যবামদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিবেশ রক্ষার বিষয়গুলো গুরুত্ব পেতে শুরু করে। সম্ভবত জিয়াউর রহমান ইউরোপীয় মধ্যবামদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
পরিবেশের বিষয় ছাড়াও জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন কর্মসূচিতে মধ্যবামদের মতো গণমুখিতা লক্ষ করা যায়। যেমন গ্রাম সরকার, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, শিল্পে শ্রমিকের মালিকানার প্রস্তাব, সমবায়ী কৃষি উৎপাদনব্যবস্থার চিন্তাভাবনা।
মোদ্দা কথা, ১৯ দফায় রাজনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি সুষম উৎপাদন ও বণ্টনের কথাই বলা হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের রাজনীতি, অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়েছে। কিন্তু যে জিনিসটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না, তা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ননীতি।
জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গীয় বদ্বীপের চরিত্র বিবেচনা করে উন্নয়ননীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। পরিবেশ, প্রকৃতির ক্ষতি না করে বরং অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
এ ক্ষেত্রে ওই সময় খাল খননের কথা উল্লেখ করা যায়। জিয়াউর রহমানের আমলে সারা দেশে ২৬ হাজার মাইল খাল খনন করা হয়েছিল। এই খালগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রভাব ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী।
প্রথমত, এই খালগুলো ছিল স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে, পরিবেশের ক্ষতি না করে পানি ব্যবস্থাপনার চমৎকার উদাহরণ। আমাদের এখানে উজান থেকে পানি আসে। আর দক্ষিণে রয়েছে লবণাক্ততা। খালগুলো পানিপ্রবাহের জায়গা বিস্তৃত করেছিল। শুষ্ক মৌসুমে জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
অথচ এখন আমরা ডেলটা প্ল্যান করে পানি সংরক্ষণাগার তৈরির কথা বলি। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালেই স্বল্প খরচে করে দেখিয়েছেন কীভাবে সারা দেশে প্রাকৃতিক জলাধার তৈরি করা সম্ভব। কৃষিতে খাল খননের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল। যে কারণ খাল খনন জাতীয় কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছিল।
এর পাশাপাশি জিয়াউর রহমান সামাজিক বনায়নে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেশের প্রতিটি মহাসড়ক, সড়ক ও মেঠো পথের দুই পাশে ফল গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের পক্ষে পুষ্টিকর ফল খাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। নেহাত অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে তিনি গাছ লাগানোর কথা বলেননি। পাশাপাশি এর সামাজিক সুবিধার কথাও বিবেচনা করেছিলেন।
মূলত জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনার ভিত্তি ছিল, মাটি, পানি, প্রকৃতি ও পরিবেশের যথাসম্ভব ক্ষতি না করে উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া। তবে এটাও ঠিক, ওই সময়ই কৃষিতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বাড়তে থাকে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য।
পরিবেশবান্ধব মধ্যবাম ধারার টেকসই উন্নয়ননীতি জিয়াউর রহমানকে বাস্তবিক অর্থেই মাঠের মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি মাঠে, খালে, বিলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেলেন। একসঙ্গে খাল কাটলেন। পাশাপাশি বসে আহার করলেন। এটাই মূলত জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।
কিন্তু জিয়াউর রহমান এখন কোথাও নেই এক অর্থে। গণমাধ্যম, বই, পুস্তক, গান, কবিতা বা সিনেমায় জিয়াউর রহমানের উপস্থিতি নেই।
আমাদের রাজনৈতিক চর্চার বর্তমান সংস্কৃতি অনুসারে থাকার কথাও না। বিএনপিও সেভাবে জিয়াউর রহমানকে তুলে ধরতে পারেনি। পোস্টার, ব্যানারে জিয়াউর রহমানের ছবি ব্যবহার আর রাজনৈতিক স্লোগানের মধ্যেই বিএনপি সীমাবদ্ধ।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, উন্নয়নদর্শনকে নতুন প্রজন্মের কাছে খুব বেশি ছড়িয়ে দিতে পারেনি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বা সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম সবাই জানেন। কিন্তু সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার মূল ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান অর্থনৈতিক সংস্কার ও জনবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে; সে সম্পর্কে খুব কমই জানে নতুন প্রজন্ম।
রিজার্ভ সংকট, ডলার–সংকট, ব্যাপক অর্থ পাচারের এই দুর্দশার মধ্যেও যে দুটি খাত কোনো রকমে ধস ঠেকিয়ে রেখেছে এখনো, তা হচ্ছে জিয়াউর রহমানের আমলে শুরু হওয়া মানবসম্পদ ও পোশাক রপ্তানি।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা, একশ্রেণির প্রতিনিয়ত সমালোচনা, পাশাপাশি নিজ দল বিএনপির নিস্পৃহতা, অদক্ষতার পরও জিয়াউর রহমান কোথাও না থেকেও যেন সর্বত্রই আছেন তাঁর বিভিন্ন গণমুখী কর্মসূচির মধ্য দিয়েই।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক