সকাল থেকে আমি ঠিক বাস্তবতার মধ্যে বাস করছি না, আমার চারপাশে এক অলীক জগৎ, যেন এক দীর্ঘ দেজাভুর মধ্যে ডুবে আছি। অথবা একজন জাতিস্মরের মতো আগের জন্মের স্মৃতিগুলো জেগে উঠেছে, আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতীতে। ঠিক এই মুহূর্তে আমার চারপাশে যা যা ঘটছে, যা কিছু আমি দেখছি, এর সবই ঠিক এভাবেই আগেও ঘটেছে।
ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুর কাছে পরাজয়…বছর আটেকের এক শিশুর নির্বাক কান্না, সেই মার্চ মাস…সবকিছু যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বিষাদের স্মৃতি ফিরে এল বিষাদের আরেক আয়োজনে।
ভোররাতে হোয়াটসঅ্যাপে মামুনের টেক্সটটা দেখার পর থেকেই যে উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কায় বুকটা কাঁপছিল, সকালবেলা ঠিক সেই দুঃস্বপ্নটাই চরম বাস্তবতা হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। জানলাম, আমাদের শশী, আতিয়া আফরিন শশী আর নেই।
শনিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তার মৃত্যু হয়েছে। গত তিন বছর ধরে শশী ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে একই বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল আবদুল্লাহ আল মামুন আর শশী। দুজনই গান করত। দারুণ প্রাণবন্ত এই যুগলের একসঙ্গে পথচলা এভাবে মাঝপথে থেমে যাবে কেউ কি ভেবেছিল! এক কন্যা ও পুত্রকে রেখে চলে গেল শশী।
এটা এমন এক নির্মম সত্য, যেটা শোনার জন্য সম্ভবত ভেতরে-ভেতরে আমাদের সবারই ছিল একধরনের অনিচ্ছুক প্রস্তুতি। তার পরেও যখনই ঘটনাটির মুখোমুখি হলাম, মনে হলো এর জন্য আমরা কেউই আসলে প্রস্তুত ছিলাম না।
প্রথম আলোতে কাজ করার সময় সহকর্মী হিসেবে পাই মামুনকে, দ্বিতীয় দফা সহকর্মী ছিল ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম ট্রেইনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট-যাত্রীতে। পরে পেশার বাঁকবদলে দুজন দুদিকে চলে গেলেও যোগাযোগটা ছিন্ন হয়নি, শশী আর মামুনের সঙ্গে ছিল আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব।
শশীকে নিয়ে যে কতটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে মামুনকে, যেটা আমি খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পারি। কারণ, ঠিক ৯ বছর আগে এই সময়টা আমিও মোকাবিলা করেছি, তার আগে ছয় বছরের লড়াইটা শুধু আমার একার ছিল না, এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় আঘাতটা সহ্য করতে হয়েছিল স্বয়ং ক্যানসার আক্রান্ত ফারহানা মাহবুব ফ্যান্সিকে। তার সঙ্গে লড়েছি আমি, আমার শিশুকন্যা আদৃতা আর আমাদের পরিবারের অন্যরাও। আজ ২০২৪ সালের ১৬ মার্চ, আর ঠিক ৯ বছর ২ দিন আগে ১০ বছরের আদৃতাকে মাতৃহীন করে ফ্যান্সির চলে যাওয়ার দিনটা ছিল ২০১৫ সালের ১৮ মার্চ।
আমি জানি, একজন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা, বেদনা আর প্রতিক্ষণে মৃত্যুর ভয় নিয়ে যে দীর্ঘ সংকুল পথ পাড়ি দিতে হয়, সেটা কতটা নিষ্করুণ। এই অনিশ্চিত যাত্রা একেকটি পরিবারের সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য কেড়ে নেয়, জীবনের অনিশ্চয়তাকে ছাপিয়ে কখনো কখনো ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থের জোগান করার চিন্তাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
যখন ছোট ছিলাম, ভাবতাম ক্যানসারের মতো রোগটির অস্তিত্বে রয়েছে শুধু নাটক-সিনেমা-উপন্যাসে। নিজের জীবনে এর উপস্থিতি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। কেউই সম্ভবত ভাবে না। তবে আমাদের ভাবনায় কী আসে যায়! মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া এই ক্যানসার কতশত স্বপ্ন ছাই করে দিচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে প্রিয়জনদের, একেকটা পরিবারকে সহায়সম্বলহীন করে তুলছে—সেই হিসাব কে রাখে!
যে চরম স্ট্রেস আর অনিশ্চয়তার জীবন আমরা যাপন করছি, বিষাক্ত খাবার খাচ্ছি, বিশ্বের নিকৃষ্টতম যে বাতাসে নিশ্বাস নিতে বাধ্য হচ্ছি, সেখানে এখনো যে আপাতদৃষ্টে সুস্থ দেহে বেঁচে আছি, দুপায়ে দাঁড়াতে পারছি, একটু-আধটু চলতে পারছি, সেটাই তো অনেক!
ভেজাল খাবার আর বিষাক্ত বাতাসের এই নরক ছেড়ে অনন্তলোকে ভালো থেকো শশী।
গোলাম কিবরিয়া
[email protected]