তখন মার্বেল-গুলতি-হাফ প্যান্ট ছেড়ে মাত্র কলব্রিজ-এয়ারগান-ফুলপ্যান্টে উঠেছি। জন্মসূত্রে থাকি গোপালগঞ্জ শহরে। পৈতৃক বাড়িতে।
শহরের মধুমতি মার্কেটের পাশ দিয়ে, বিখ্যাত পাঁচুড়িয়া খালের পাড় দিয়ে দক্ষিণ দিকে একটা রাস্তা বয়ে গেছে। সেই রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়লে আধা-সিগারেট দূরত্বেই দক্ষিণ মোহাম্মাদপাড়া। সেখানে শুক গোঁসাইয়ের আশ্রম (শ্রী শ্রী বিশ্ব শুকদেব ব্রহ্মচারী সেবাশ্রম সংঘ)। পিতৃগৃহ কাছে হওয়ার কারণে আমার এবং সমবয়সী বন্ধুদের আড্ডা হতো আশ্রমের ভেতরেই।
নব্বইয়ের দশকের একেবারে শুরুর দিকের কোনো এক বিকেলে সুনীল, পাভেল, কাজল, সজল, মুকুল, তবি, লিটু এবং ‘নাম মনে আনতে পারছি না’ টাইপের বন্ধুদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আশ্রমের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাঁচুড়িয়া খালের পাড়ে আশ্রমটির ঘাটলায় বসে কেউ হয়তো বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিল। ঘাটলার পাশের বেতের ঝোপের কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া পায়ে হাঁটা রাস্তায় ছেলেপেলে হয়তো মার্বেল খেলছিল।
এ রকম একটা পরিবেশে খুব ধোপদুরস্ত পোশাকে কয়েকজন যুবক কয়েকটা মোটরসাইকেলে করে আশ্রমে ঢুকলেন। যাঁরা সেখানে এলেন, তাঁদের মধ্যে একজনের চেহারা, পোশাক, হাবভাব একেবারে আলাদা। তাঁর মাথায় মেয়েদের মতো কালো লম্বা চুল। পরনে জিনসের প্যান্ট, গায়ে আঁটসাঁট টি শার্ট। দুর্দান্ত স্মার্ট। ওই সময়ে মফস্বল শহরে এমন স্মার্ট যুবক খুব একটা চোখে পড়ত না।
তাঁরা আশ্রমে ঢোকার পরই সেখানে ছোটখাটো একটা জটলা লেগে গেল। বন্ধুদের কাছে শুনলাম, বড় চুলের যে বড় ভাইয়ের কারণে জটলাটা লেগেছে, তিনি চাইম ব্যান্ডের ভোকাল খালিদ।
ক্যাসেটের ফুটোয় ইকোনো কলম ঢুকিয়ে ফিতে প্যাঁচানোর সেই যুগে ‘নাতি খাতি বেলা গেল শুতি পারলাম না, আহারে ছদরুদ্দির মা’; ‘ও আমার হাঁসের ছাও রে’; ‘কীর্ত্তনখোলা নদীরে আমার’—খালিদ ভাইয়ের এই গানগুলো তখন আমাদের মুখে মুখে বাজত। সেই শিল্পীকে চাক্ষুষ দেখছি! ভেতরে বিরাট উত্তেজনা শুরু হলো।
তারপর বহুবার তাঁকে দেখি গোপালগঞ্জ শহরের রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ। সালাম দিলে ঘাড় কাত করে জবাব দেন। ঠোঁটের কোনায় হাসির মতো ঝিলিক দেখা যায়। এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে তাঁর বাড়ি। থাকেন ঢাকায়। মাঝে মধ্যে ‘দেশের বাড়িতে’ আসেন। বিটিভিতে তাঁকে গাইতে দেখি। তাঁর ব্যাপারে কৌতূহল কাটে না; একটা বিস্ময় ভেতরে-ভেতরে কাজ করে।
তো, আশ্রমের গোয়াল ঘরের সামনে হোগলার চাটাই কিংবা খেজুরের পাটি জাতীয় কিছু পেতে দেওয়া হলো। আশ্রমেরই কীর্তন ঘর থেকে একটা হারমোনিয়াম আনা হলো। তবলা ছাড়াই শুধু হারমোনিয়ামে খালিদ ভাই গাওয়া শুরু করলেন। আমরা সবাই তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে বসলাম।
যদ্দুর মনে পড়ে, সেদিন তিনি তাঁর হিট গানগুলো গাইলেন না। মান্না দে কিংবা সতীনাথ টাইপের কোনো শিল্পীর কয়েকটি গান গাইলেন। সেই প্রথম খালিদ ভাইকে মুখোমুখি দেখা। সরাসরি তাঁর মুখে প্রথম গান শোনা।
তারপর বহুবার তাঁকে দেখি গোপালগঞ্জ শহরের রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ। সালাম দিলে ঘাড় কাত করে জবাব দেন। ঠোঁটের কোনায় হাসির মতো ঝিলিক দেখা যায়।
এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে তাঁর বাড়ি। থাকেন ঢাকায়। মাঝে মধ্যে ‘দেশের বাড়িতে’ আসেন। বিটিভিতে তাঁকে গাইতে দেখি। তাঁর ব্যাপারে কৌতূহল কাটে না; একটা বিস্ময় ভেতরে-ভেতরে কাজ করে।
সময় যায়। আমরা বড় হতে থাকি। খালিদ ভাইয়ের মৌলিক গানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ‘নাতি খাতি বেলা গেল শুতি পারলাম না, আহারে ছদরুদ্দির মা’; ‘ও আমার হাঁসের ছাও রে’—এই ধরনের দক্ষিণ বঙ্গীয় ফোক ঘরানা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে থাকেন। তাঁর ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে’, ‘হয়নি যাবারও বেলা’, ‘তুমি নেই তাই’, ‘আকাশনীলা’—এই ধরনের নাগরিক বাণী ও চিন্তাকেন্দ্রীক গান বাজারে আসতে থাকে। প্রায় প্রত্যেকটি গান হিট করতে থাকে।
মনে পড়ছে ২০০১ বা ২০০২ সালের দিকের আরেকটি সন্ধ্যার কথা। গোপালগঞ্জ পৌরসভার পেছনের মরা মধুমতির ওপারে যে শিশুবন ছিল (এখন যেখানে শেখ মনি অডিটরিয়াম), সেই বনের মধ্যে ঘাসের ওপর বসে খালিদ ভাই খালি গলায় একের পর এক গান গাইছিলেন। আমরা তাঁকে ঘিরে হাত তালি দিয়ে যাচ্ছিলাম।
নখ থেকে চুল পর্যন্ত শিল্পী ছিলেন তিনি। নব্বই দশকে যাঁদের যৌবন উদ্গত, তাঁদের কাছে খালিদ একটা অবসেশনের নাম। ওই সময়টাতে ব্যান্ড সংগীত একটা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ব্যান্ডে তখন মেটালিক মিউজিক ঢুকতে শুরু করেছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম দিন শেষে মেলোডিতেই যেন মানসিক আশ্রয় খুঁজে পেত।
‘তুমি আকাশের বুকে/বিশালতার উপমা’ কিংবা ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’ অথবা ‘কোনো কারণে ফেরানো গেল না তাঁকে’-এসব গান অন্তত দুই দশক একটার পর একটা প্রজন্মের মগজে-হৃদয়ে বসে গেছে। অদ্ভুত একটা মেলোডি টোন তাঁর কণ্ঠে লুকানো ছিল। সেই কারণে তিনি আমাদের কালের একজন নায়ক হয়ে মনে গেঁথে গিয়েছিলেন।
সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাজ্জাদের ছোট বোন কথাশিল্পী শামীমা জামানকে বিয়ে করে খালিদ ভাই অবশেষে ‘ভগ্নিপতি’ হয়ে গেলেন। ২০০৪ সালের দিকে যখন জিগাতলার একটা ফ্ল্যাটে সাজ্জাদ, তাঁর ছোটভাই মাহমুদ ও আমিসহ অন্যরা থাকতাম।
ওই সময় মাহমুদ একদিন একটা টেপ রেকর্ডার কানের কাছে বাজিয়ে বলল, ‘শোনেন তো ভাই, গানটা কেমন?’ সম্ভবত গানটা ছিল ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’। সে গানে কোনো মিউজিক নেই। খালিদ ভাইয়ের ‘র’ কণ্ঠ। গানটা তখনও ফাইনাল রেকর্ডিং হয়নি। মিউজিক সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় মাহমুদকে বললাম, ‘ধুর কিসসু হয় নাই। এই গান পাবলিক খাবে না।’ কিন্তু পরে দেখলাম, কী ভয়াবহ জনপ্রিয় হলো গানটা।
আরেকদিন জিগাতলার ফ্ল্যাটে একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকল মাহমুদ।
মাহমুদ বলল, ‘ভাই, শামীমা আপুর ছেলে হয়েছে।’ সেই মিষ্টি খেলাম। কিন্তু কিছুদিন বাদে খালিদ ভাই সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ায় ভাগ্নে জুয়াইফা আরিফকে সরাসরি দেখা হয়নি।
গতকাল তরুণ জুয়াইফাকে দেখলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একটি ভিডিওতে তাঁকে বলতে শুনলাম, ‘আপনারা আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। মাফ করে দিয়েন তাঁকে।’ তাঁর কথা শুনছিলাম, তাঁকে বারবার দেখছিলাম। মনে বারবার খালিদ ভাই ফিরে ফিরে আসছিলেন।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]