আজ ১৭ নভেম্বর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ভাসানীর অনুসারীরা আজ নানাভাবে তাঁকে স্মরণ করছেন। কেউ স্মরণ করছেন মিছিলে–স্লোগানে, আবার কেউ স্মরণ করছেন হয়তো প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীরের সেই বিখ্যাত গান শোনে, ‘ভাসানীর ভাষা ভেসে আসে ওই মিছিলের গর্জনে/ কিষান–কামার এই বাংলার মেহনতি লাখো জনে।’ এই দিনে কবি শামসুর রাহমানের ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ কবিতা পড়েও ভাসানীকে স্মরণ করা যায়।
যুগে যুগে জনে-জনের অন্তরে জিইয়ে আছেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। যিনি আমৃত্যু কৃষক, শ্রমিক, জেলে, মজুর, কামার, কুমার, তাঁতি ও খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করে গেছেন।
সময়ের প্রয়োজনে মানুষের মধ্যে ভাসানীর নীতি-আদর্শের আবার জাগরণ হচ্ছে বলে বিশ্বাস করেন ভাসানীর নাতি টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার আজাদ খান ভাসানী। তাঁর ভাষ্য, দেশ-বিদেশের নানা সংকট ও সম্ভাবনায় ভাসানী প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন ও তিনি ফিরে ফিরে আসছেন। বর্তমানে ভাসানীকে নিয়ে বিদেশেও গবেষণা হচ্ছে, চর্চা হচ্ছে, হচ্ছে সভা ও সম্মেলন। অথচ দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু হচ্ছে না।
গত ১০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি মিলনায়তনে চতুর্থ আন্তর্জাতিক ভাসানী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি আয়োজন করেছে নিউইয়র্কের মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফাউন্ডেশন। একদিনের ওই সম্মেলনে ভারত, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ থেকে ভাসানী অনুরাগীরা যোগ দেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকেও ভাসানী–ভক্তরা সেখানে শামিল হন। সম্মেলনে সব মিলিয়ে ৪০০-৫০০ মানুষের সমাগম ঘটে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিশিষ্টজনেরা ভাসানীর জীবনসংগ্রামের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন।
কলকাতা থেকে যোগ দেন লেখক ও নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার। সম্মেলনের মঞ্চে তাঁর নির্মিত ভাসানীর জীবনের ওপর নির্মাণ করা ২০ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। মঞ্চের ভাষণে সৌমিত্র দস্তিদার বলেন, আজকের দিনে রাজনীতিবিদেরা মূল্যবোধের রাজনীতি থেকে সরে গেছেন। তবে ভাসানী সারা জীবন মূল্যবোধের রাজনীতির চর্চা করে গেছেন। নিপীড়িত জাতিসত্তার পক্ষে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম অবিস্মরণীয়।
ওই সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বক্তৃতা করেন। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যাঁরা ওই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, তাঁদের অনেকে ভাসানীর সাহচর্য পেয়েছেন। আয়োজনে তাঁদের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা ছিল। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, সেখানে যুবকদের অংশগ্রহণ কম ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয় মাওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী যে মাপের মানুষ। সেইভাবে তাঁদের নিয়ে দেশে আলোচনা হয় না, আয়োজন হয় না। নিউইয়র্কে এমন আয়োজন ইতিবাচক।’
২০১০ সালে নিউইয়র্কে ভাসানী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন অধ্যাপক শামসুল আরেফিন, ভাসানী অনুসারী আতিকুর রহমান, মোহাম্মদ হোসেন ও মঈনুদ্দীন নাসের। তাঁদের প্রচেষ্টায় সে বছর সেখানে প্রথম আন্তর্জাতিক ভাসানী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়টি হয় ২০১৩ সালে, তৃতীয়টি হয় ২০১৬ সালে। ফাউন্ডেশনটির সাধারণ সম্পাদক প্রবাসী বাঙালি মঈনুদ্দীন নাসের বলেন, ভাসানী যেভাবে ক্ষমতার লোভ ছাড়াই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সংগ্রামের রাজনীতি করেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই চেতনা জাগ্রত করাই তাঁদের লক্ষ্য।
নিউইয়র্কের একটি মানবাধিকার সংস্থায় কর্মরত আছেন ভাসানী ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজি ফৌজিয়া। হোয়াটসঅ্যাপে আলাপকালে তিনি বললেন, নতুন প্রজন্মের একটি অংশ ভাসানীকে প্রায় ভুলে গেছে। তাঁদের কাছে ভাসানীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভাসানীকে নতুন করে তুলে ধরার জন্য ফাউন্ডেশনটি কাজ করছে।
সম্প্রতি কলকাতায়ও তৈরি হয়েছে ভাসানী চর্চা কেন্দ্র। শিক্ষক, লেখক, নির্মাতা, শিক্ষার্থী, গবেষকগ্রন্থ প্রকাশকসহ নানা পেশার মানুষ সেখানে যোগ দিয়েছেন। টাঙ্গাইলেও আছে মাওলানা ভাসানী রিসার্চ সেন্টার। যুক্তরাজ্যে ভাসানীকে নিয়ে গবেষণা করছেন লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক লাইলী উদ্দিন। কানাডার ডাউসন কলেজের অধ্যাপক আবিদ বাহার পিএইচডি করেছেন ভাসানীর ওপর।
দেশে দেশে ভাসানীর অসংখ্য অনুরাগী যেমন আছেন, বিরাগভাজন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বিরাগভাজনেরা এখনো ভাসানীকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। সমালোচনার মুখে দাঁড় করান। তাঁদের অভিযোগ, ভাসানী কোনো দল, মত ও আদর্শে স্থির ছিলেন না। ছিলেন অস্থিরচিত্ত রাজনীতিবিদ। নিজের সুবিধার জন্য শুধু দল বদল করতেন।
এসব সমালোচনার উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন লেখক-চিন্তাবিদ আহমদ ছফা। এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘মাওলানা ভাসানী ছিলেন হাড়ে, মাংসে, অস্থিমজ্জায় কৃষক সম্প্রদায়ের নেতা। স্বভাবে, আচরণে, জীবনযাপন পদ্ধতিতে তিনি নিজেও ছিলেন মহান কৃষক। তাঁর চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কৃষকসমাজ। যখনই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, তিনি মনে করেছেন, এই দলটির সঙ্গে কাজ করলে কৃষকসমাজের দাবিদাওয়া এগিয়ে নিতে পারবেন। পরক্ষণে যখনই তাঁর মনে হয়েছে, এই দলটি কৃষকসমাজের স্বার্থবিরোধী, কায়েমি স্বার্থের তল্পিবাহকে পরিণত হয়েছে। তখনই দল ছাড়তে তাঁর একমুহূর্ত সময়ও ব্যয় হয়নি।’
নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভাসানী ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসীন হননি। তাঁর ব্যক্তিজীবন খুব কাছ থেকে দেখেছেন বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী মো. ইউনুছ আলী। সন্তোষে ভাসানীর বাড়িতে থেকে ১৯৭৪-৭৫ সালে কাগমারী কলেজে পড়ালেখা করেছেন তিনি। এতে ভাসানীর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছে তাঁর। সম্প্রতি আলাপকালে ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুকে একসঙ্গে প্রত্যক্ষ দর্শনের দুর্লভ স্মৃতি স্মরণ করে ইউনুছ আলী বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ। বঙ্গবন্ধু সন্তোষে এসেছেন ভাসানী হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে নামার পর ভাসানী হুজুর তাঁকে দুটি তোয়ালে উপহার দেন। কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে ভাসানী বললেন, ‘মুজিবর, আমি তোমাকে কী বলব, তুমি দেশের প্রেসিডেন্ট, আবার জাতির পিতা হইছ। তোমাকে বলার কিছু নাই। তবে আমি যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করছি, সেগুলোর প্রতি একটু নজর রাখিও।’ সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘হুজুর আপনি বলেন কী? আমি যদি জাতির পিতা হই। আপনি, জাতির দাদু।’
দেশের জাতীয় রাজনীতিতে ভাসানীর বংশের উত্তরাধিকারীরা ক্ষমতাসীন হতে পারেননি। যে কারণে বৃহৎ পরিসরে ভাসানীকে তুলে ধরার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা। ফলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়েও ভাসানী রয়ে গেছেন আড়ালে-অন্তরালে। এমন বাস্তবতায় ভাসানী কাহিনি বইয়ের মুখবন্ধে গবেষক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেন, ‘জাতীয় জীবনের রাজনীতির অঙ্গনে মাওলানা ভাসানী আজ অবহেলিত। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের কাছে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। মনে রেখেছে তাঁকে সাধারণ মানুষ।’
আজ ভাসানীর মৃত্যুদিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি নেই। তবে সন্তোষে ভাসানীর মাজার প্রাঙ্গণে, সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া গ্রামে ভাসানীর জন্মস্থানে, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর ভাসানী বাড়িতে ও ভারতে আসামের ভাসানচরসহ কয়েকটি স্থানে কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, খাবার বিতরণ, আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ভাসানীকে স্মরণ করা হচ্ছে। ভাসানী তাঁর জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘দারিদ্র্যকে দূর করিয়া দাও, শোষণকে উচ্ছেদ করিয়া দাও, সবার মুখে হাসি ফুটিতে দাও, তবেই আমার কাজ ফুরাইবে।’
ভাসানীর কাজ ফুরায়নি। তাঁর ভক্ত, অনুসারী ও অনুরাগীরা মনে করেন, পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে ভাসানীই প্রথম পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ স্বাধীন করার হুংকার দিয়েছিলেন। অত্যাচারী শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে ভাসানীর ‘খামোশ’ উচ্চারণ সর্বকালে প্রাসঙ্গিক। ভাসানীর বলিষ্ঠ কণ্ঠের ভাষণ এখনো ভেসে বেড়ায় মানুষের হৃদয়ে।
তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]