সংবিধান হলো একটা দেশের আইনের মূল ভিত্তি। এ সংবিধানই দেশের নাগরিকদের বড় রক্ষাকবচ। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের প্রস্তুতকৃত খসড়া সংবিধানটি গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে বিল আকারে উত্থাপন করা হয়। মাত্র ২৩ দিনের মাথায় ৪ নভেম্বর এ খসড়া সংবিধানটি গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং সেটি ওই বছরের, অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়।
গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময়কাল বিবেচনায় নিলে এটা পরিষ্কার যে সদ্য স্বাধীন দেশের খসড়া সংবিধান হিসেবে এটি বেশ তড়িঘড়ি করে গণপরিষদে পাস করানো হয়েছে। তৎকালীন সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিংবা দেশের সব নাগরিকের অধিকার সংবিধান নামক দেশের রক্ষাকবচে প্রতিফলিত হলো কি না, সেসব কিছুই যাচাই করা হয়নি। গণপরিষদের নির্দলীয় সদস্য এম এন লারমা ও ন্যাপের প্রতিনিধি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনা করতে চাইলেও তাঁদের বারবার থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কথা বলতে বাধা প্রদান করা হয়েছিল।
অথচ মানবেন্দ্র নারায়ল লারমা ( এম এন লারমা) নির্দলীয় প্রতিনিধি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সারা দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, শোষিত, নিপীড়িত, অধিকারহারা শ্রমিক, কৃষক, জেলে, তাঁতি, যৌনকর্মীসহ সব বঞ্চিত মানুষের কথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রবল বাঙালি জাত্যভিমানী সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা বাঙালি জাতীয়তাবাদে এতটাই বুঁদ হয়ে নিমগ্ন ছিল যে গণপরিষদের নির্দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রতিনিধিদের মতামতও মন দিয়ে শোনার ধৈর্য ও সক্ষমতা সে সময় তাদের ছিল না।
এখানে ‘সক্ষমতা’ এ কারণেই বললাম যে ৫০ বছর আগে এম এন লারমা তাঁর গভীর চেতনা ও দূরদৃষ্টি থেকে যেটি উপলব্ধি করেছিলেন, সেই উপলব্ধি তৈরি হতে এ জাত্যভিমানী জাতির সময় লাগল আরও ৫০ বছর! গত ৫০ বছরে বহুবার সংবিধান সংশোধন, পরিবর্ধন, পরিমার্জনের পরেও আজও সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়ে গেছে।
হ্যাঁ, সংবিধান যেহেতু দেশের সাধারণ জনগণের রক্ষাকবচ, আইনের মূল স্তম্ভ; কাজেই যতক্ষণ এটি জনবান্ধব হবে না, মেহনতি মানুষের অধিকারের কথাগুলো এখানে প্রতিফলিত হবে না, ততক্ষণ এর সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি।
৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর দেশকে আবারও নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার সহায়ক যন্ত্রগুলোর বিভিন্ন খাঁজে ও ভাঁজে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা জং ধরা বৈষম্যের যন্ত্রপাতিগুলো পরিষ্কারের কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। এসব সংস্কারকাজ দেখে এ দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে আদিবাসী জনগণও আশার আলো নিয়ে ভালোর প্রত্যাশা করেছে। কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগ ও হতাশার সঙ্গে আমরা লক্ষ করলাম, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যতগুলো কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার কোনোটাতেই আদিবাসী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তাহলে কি সংবিধান প্রণয়নের ৫২ বছর পর আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে?
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর সংবিধান বিলের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ, যেখানে নাগরিকত্বের প্রস্তাবে, ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’—ধারাটি পাস করা হয়, তখন চাপিয়ে দেওয়া এ পরিচিতির বিপক্ষে প্রতিবাদস্বরূপ এন এন লারমা গণপরিষদ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বেরিয়ে যান।
এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে বিলটির ওপর আলোচনার সময় তৎকালীন স্পিকার এম এন লারমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি বাঙালি হতে চান না?’ তাই এ সময়ে এসে মনে বারবার এ প্রশ্ন জাগছে, দেশ সংস্কারের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার করতে গিয়ে আবারও কি জাত্যভিমানী এ জাতি একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছে না তো! এখানেই আমাদের প্রশ্ন—অতীতের পাঁচ দশকের ভুল থেকেও কি আমরা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারিনি? নাকি, এ দেশের নীতিনির্ধারকদের মনোজগতে আদিবাসী অধিকারের ইস্যুটি আজও সুদূরে রয়ে গেছে!
আগেই উল্লেখ করেছি, এম এন লারমা শুধু পাহাড়ের জাতিসত্তাগুলোর স্বীকৃতি ও অধিকারের কথা ভাবেননি। তিনি একই সঙ্গে সমতলের জাতিসত্তাদের কথা, নিম্নবর্গ প্রান্তিক মানুষগুলোর কথা বারবার গণপরিষদে উত্থাপন করেছিলেন, দাবি তুলেছিলেন তাঁদের অধিকারগুলো যেন সংবিধানে স্থান পায়। এম এন লারমা ছিলেন প্রকৃতই মেহনতি মানুষের প্রতিনিধি। তিনি সর্বদা চেয়েছিলেন একটি সাম্য ও ন্যায্য সমাজ, যেখানে আদিবাসী, নিম্নবর্গ প্রান্তিক মানুষেরও ন্যায্যতা নিশ্চিত হবে।
এম এন লারমা ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন রাজনৈতিক নেতা, যিনি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে সব মেহনতি মানুষের কথা যেমন ভাবতেন, তেমনি সংসদে দাঁড়িয়ে তাদের কথা বলে গেছেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে। তিনি শুধু দেশ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ, কারাগার সংস্কার, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন, বাক-স্বাধীনতার কথা বলেননি, একই সঙ্গে দেশের শোষিত-বঞ্চিত কৃষক, শ্রমিক, মাঝি, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতিদের অধিকার নিয়েও সবসময় সোচ্চার ছিলেন।
ব্যক্তি জীবনেও এম এন লারমা ছিলেন খুবই মৃদুভাষী, অমায়িক, নম্র, ক্ষমাশীল, সৎ ও নিষ্ঠাবান। তিনি অত্যন্ত সাধাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। কর্মময় জীবনেও তিনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। শিক্ষকতা ও আইন পেশায় ছিল তার যথেষ্ট সুনাম আর খ্যাতি। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ এবং একজন সচেতন পরিবেশবাদীও। যতদিন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন, ততদিন পাহাড়ের জীব-পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর তার ছিল কড়া নজরদারি। একদিকে পরিবেশ বজায় রাখতে গিয়ে জুমচাষিদের যাতে কোনোরূপ ক্ষতির মুখোমুখি হতে না হয় সেদিকে যেমন ছিল তার সজাগ দৃষ্টি, তেমনি জুমচাষের জন্য জুমভূমি পোড়াতে গিয়ে যেন প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট না হয় সে জন্য বাতাসের গতিবেগ দেখে জুম পোড়ানোর সময় জুমচাষিদের সহযোগিতা করতে পার্টি কর্মীদের নির্দেশ দিতেন।
এম এন লারমা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সাল থেকেই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখার অপরাধে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ১৯৬৩ সালে তাকে আটক করে। এ সময় প্রায় দুই বছর তাকে জেলে বন্দি থাকতে হয়। জেলে পুরেও তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সারা দেশ থেকে তিনিই একমাত্র নির্দলীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১০ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের এ মহান নেতার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর তাঁকে হত্যা করে তাঁর চেতনাকে স্তব্ধ করে দিতে চাইলেও তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ মেহনতি মানুষের কাছে তাঁর চিন্তাচেতনা আজও জ্বলজ্বল করে বিদ্যমান। দেশের বর্তমান এ সময়ে এসে যে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, এম এন লারমার গভীর চিন্তাচেতনা ও দূরদর্শিতা দেশ পুনর্গঠনের জন্য এখনো কতটুকু প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বের দাবি রাখে।
সবশেষে এ কথা বলতে চাই, রাষ্ট্র সংস্কারের সব কাজে আদিবাসী, প্রান্তিক মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। দেশ পুনর্গঠনে তাঁদেরও ভূমিকা রাখার ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হোক।
● ইলিরা দেওয়ান মানবাধিকারকর্মী