মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২০ সালের ১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।
একজন মানবিক লতিফুর রহমানকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, মানুষকে বড্ড বিশ্বাস করতেন, আর চাইতেন তাঁর সঙ্গে মানুষের একটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের সম্পর্ক গড়ে উঠুক।
একজন সফল উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্ণধার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পেছনে তাঁর মানবিকতার বা চিরন্তন যে মানবধর্মে তিনি বিশ্বাস রাখতেন, সেটি অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল বলে আমার ধারণা। কেননা, দিন শেষে তথাকথিত লেনদেনের বাইরে গিয়ে তিনি মানবিক সম্পর্কে উপনীত হতেন এবং একে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। এটি সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হতো তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোর সহকর্মীদের সঙ্গে। কাউকেই তিনি আক্ষরিক অর্থে কর্মচারী মনে করতেন না, বরং প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাধনে এক পরিবারের সদস্য হিসেবে সবাইকে তিনি বেঁধে রাখতেন। এ কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোয় দীর্ঘমেয়াদি কর্মীর সংখ্যা অনেক এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান বদলের হারও অত্যন্ত কম।
লতিফুর রহমানের বেশির ভাগ ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ছিল বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে। তিনি সব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকতেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের তরুণদের একটি জোরালো পেশাদারি অবস্থান তৈরি করে নেওয়ার ব্যাপারে তিনি সবাইকে খুবই উৎসাহ দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এভাবেই বাংলাদেশের করপোরেট জগতে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা সম্ভব। তিনি বাংলাদেশে অবস্থিত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোয় বাঙালি পেশাদারদের উচ্চ পদে দেখতে চাইতেন।
তাঁর আন্তরিক প্রত্যাশা ছিল বিশেষ করে প্রধান নির্বাহী পদে বাঙালিদের অবস্থান সুদৃঢ় হোক। তিনি মনে করতেন দেশের জন্য এটি দরকার, যাতে এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বাজারের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো বহির্বিশ্বের কাছে দেশীয় নির্বাহীরা কার্যকরভাবে উপস্থাপন করে একটি ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশে আজ অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতা পেয়েছে।
ব্যাংকিং সূত্রে ব্যক্তিগতভাবে লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় দুই দশকেরও বেশি আগে। ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে আমার বাংলাদেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সেই সুবাদে তাঁকে খুব নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করার এবং বিমানে পাশাপাশি বসে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছে। সেখান থেকে আমার মনে হয়েছে, তিনি ছিলেন মানবিক মূল্যবোধে পূর্ণ একজন মানুষ। পেশাদার জীবনে প্রাথমিক পর্যায়ে পরিচয়ের পর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে একই রকম আচরণ, উৎসাহ, উদ্দীপনা ও পরামর্শ পেয়েছি।
দুটি ভ্রমণের কথা বিশেষভাবে না বললেই নয়। এর একটি ছিল চায়না এক্সপো সাংহাইতে, খুব সম্ভবত ২০১০ সালে। সেখানে দেখেছি কীভাবে লতিফুর রহমান মানুষের সঙ্গে মিশে গেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল সবাইকে আপন করে নেওয়ার। বিভিন্ন দেশের অভ্যাগত ব্যক্তিদের সামনে বাংলাদেশকে উপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে উপস্থাপনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। নতুন উদ্ভাবিত কারিগরি কৌশলের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। সাংহাইতে এক্সপোর যেখানেই তিনি গেছেন, তাঁকে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে এবং প্রশ্ন করে জেনে নিতে দেখেছি।
সেবারের সফরে লতিফুর রহমানের কাছে শুধু দুজনে মিলে একটা ব্রেকফাস্ট মিটিংয়ের সময় চেয়েছিলাম। সেই ২০১০ সালেই তিনি প্রথম আমাকে বলেছিলেন প্রধান নির্বাহী হওয়ার প্রস্তুতি নিতে এবং এইচএসবিসি বাংলাদেশ বা গ্রুপের সঙ্গে থেকে প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রার জন্য দীর্ঘমেয়াদি একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করতে।
আরেকটি স্মৃতি ২০১৭ সালের। মুম্বাইতে লতিফুর রহমান সেবার সার্ক আউটস্ট্যান্ডিং লিডার সম্মানে ভূষিত হন। আমার সে অনুষ্ঠানে থাকার সুযোগ হয়েছিল। তিনিই প্রথম ভারতের বাইরের থেকে এই সম্মান পেয়েছিলেন। অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তির মধ্যে তাঁকে দেখে খুব আনন্দ হয়েছিল। তাঁকে অভাবনীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তাঁর নৈতিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের দিকটি উল্লেখ করে যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন সবার কথায় তাঁর মানবিক গুণাবলির কথাই ফিরে ফিরে আসছিল। অনুষ্ঠানের ঠিক পরদিন মুম্বাইয়ে জুলাই মাসের বৃষ্টিস্নাত সকালে আমরা বসেছিলাম আলাপচারিতায়। বহু কথা হয়েছিল, তাঁর কর্মজীবন আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আরও কত–কী! সেসব কি ভোলা যায়?
লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয় টেলিফোনে, ২০২০ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। তাঁকে সেদিন জানিয়েছিলাম ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে আমার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। ১০ বছর আগে আমার সঙ্গে তিনি যে কথার অবতারণা করেছিলেন, তা শুনতে পাওয়ার আনন্দ বুঝতে পেরেছিলাম ফোনের ওপারে তাঁর কথোপকথন থেকে। সেই ফোনালাপের পর প্রায় চার মাসের মাথায় তিনি চলে গেলেন।
আমি মনে করি, এই পার্থিব জীবনে লতিফুর রহমানের—আমাদের শামীম ভাইয়ের—‘সর্বসাধন সিদ্ধ’ হয়েছে। কারণ তিনি মনেপ্রাণে ‘মানুষ গুরু’তেই নিষ্ঠাবান ছিলেন।
মো. মাহবুব উর রহমান: এইচএসবিসি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা