একজন দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি

ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২০ সালের ১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।

ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান (২৮ আগস্ট ১৯৪৫—১ জুলাই ২০২০)

মানুষ হিসেবে লতিফুর রহমানের অন্যতম তিনটি বৈশিষ্ট্যের ওপর আমি এই ক্ষুদ্র লেখায় আলোকপাত করব। আমার বিবেচনায় এই বৈশিষ্ট্য তিনটি ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। প্রথমত, সততা। তাঁর যে ব্যবসায়িক সততার কথা আমরা জানি, সেটি কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় ছিল না। সেটি ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর সদাচরণের প্রতিফলন। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর অনুরাগ।

পেশাগত দিক থেকে তিনি সাংবাদিক ছিলেন না। কিন্তু গণমাধ্যমের বিনিয়োগকারী হিসেবে তাঁর মধ্যে ছিল সাংবাদিকতার মূল্যবোধের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা। আর তৃতীয়ত, দেশপ্রেম। সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর আগ্রহের মূলে ছিল এই দেশপ্রেম। প্রকৃতপক্ষে তাঁর পুরো জীবন ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের কেন্দ্রভূমি ছিল বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন

ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রতিষ্ঠা থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে তাঁকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। একটা কথা তিনি বারবার আমাদের বলতেন, সততার সঙ্গে চলতে হবে, কর দিতে হবে, সব কাজে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা রাখতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি বলে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, তাঁর নতুন সব উদ্যোগ বা ব্যবসায়িক প্রসারের কোনো জায়গাতেই সততার ব্যাপারে তিনি কখনো আপস করেননি।

সভা শেষ হলে লতিফুর রহমান প্রায়ই বলতেন, ‘মাহ্‌ফুজ, তোমার কাগজ কেমন চলছে?’ তাঁকে কখনো ‘আমাদের কাগজ’ কথাটা বলতে শুনিনি। আমি বলতাম, ‘আপনি কী বলছেন? এটা আমার কাগজ কোথায়?’ তিনি বলতেন, ‘একটা কথা মাথায় রেখো, পত্রিকার স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পাদক হিসেবে তোমার।’

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করি। লতিফুর রহমানের একবার একটি টেলিভিশন চ্যানেল কেনার সম্ভাবনা তৈরি হলো। তা নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েও গেল। আলোচনার শেষ দিকে এসে তিনি জানতে পারলেন, টেলিভিশন স্টেশনটি চালাতে স্যাটেলাইটের জন্য যে টাকা পরিশোধ করতে হয়, সেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন তাদের ছিল না। শুধু এই একটি কারণে তিনি প্রতিষ্ঠানটি কেনা থেকে পিছিয়ে এলেন। পত্রিকার পাশাপাশি একটি টেলিভিশন চ্যানেলও হবে, এই নিয়ে আমাদের অনেকে উৎসাহী ছিলেন। সেটা আর হলো না। এটা অনেক উদাহরণের একটিমাত্র। ব্যবসা প্রসারের নানা সম্ভাবনার সুযোগ তিনি সংবরণ করতেন সততার তাগিদে।

স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর যে একনিষ্ঠ ভালোবাসা ও অটল সমর্থন, তা আমাদের সব সময় মুগ্ধ করত। আমি নিজে একজন পেশাদার সাংবাদিক। স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি আমার ভালোবাসা স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি তো সাংবাদিকতার জগতের কেউ নন। ডেইলি স্টার প্রতিষ্ঠার আগে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না। তাঁর এই মূল্যবোধ কোথা থেকে এল এবং কীভাবে তিনি এত দৃঢ়ভাবে তা ধরে রাখলেন, সেটা বিস্ময়কর।

৩০ বছরের বেশি সময় ধরে যে আমি লতিফুর রহমানের সান্নিধ্য পেয়েছি, সে কারণে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি।

ডেইলি স্টার-এর পরিচালনা পর্ষদের সভায় লতিফুর রহমানের আলোচনার বিষয় হতো প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক দিক—পত্রিকা কীভাবে চলছে, এর সার্কুলেশন বা বিজ্ঞাপনের কী অবস্থা, কোথায় ব্যয় সংকোচন করা সম্ভব এসব। এ ধরনের সভায় জবাবদিহির কোনো সীমা থাকত না, কিন্তু সবই হতো আর্থিক বিষয়ে। আলোচনার আরেকটা বিষয় হতো সাংবাদিকদের কীভাবে আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, লভ্যাংশ থেকে ওদের কিছু দেওয়া যায় কি না ইত্যাদি। আমাদের সম্পাদকীয় নীতি বা সাংবাদিকতার বিষয়াদি নিয়ে কখনোই তিনি কথা বলতেন না।

সভা শেষ হলে লতিফুর রহমান প্রায়ই বলতেন, ‘মাহ্‌ফুজ, তোমার কাগজ কেমন চলছে?’ তাঁকে কখনো ‘আমাদের কাগজ’ কথাটা বলতে শুনিনি। আমি বলতাম, ‘আপনি কী বলছেন? এটা আমার কাগজ কোথায়?’ তিনি বলতেন, ‘একটা কথা মাথায় রেখো, পত্রিকার স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পাদক হিসেবে তোমার।’

কথাটা বলা সহজ, কাজে প্রমাণ করা অসম্ভব কঠিন। সাংবাদিকেরা সব সময় প্রস্তুত থাকেন যে কোনো একটা লেখার জন্য তাঁদের ওপর চাপ আসতে পারে। অথচ ভেবে দেখুন, আমাদের সাংবাদিকতার কারণে উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর ওপর বারবার চাপ আসছে, আর তিনি সেটা সহ্য করে চলেছেন। একদিনও তিনি বলেননি, তোমরা ওই খবরটা ছেপেছ বলে আমার ওপর চাপ এসেছে।

আমি এবং প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান তাই অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলে এসেছি যে আমরা পৃথিবীর অন্যতম স্বাধীন সম্পাদক। আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চা করার বিরাট এই পরিমণ্ডল কোনো একটি ঘটনা বা একটা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হয়নি। এটি গড়ে উঠেছে দিনের পর দিন অজস্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মতো দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিফলন তার বিনিয়োগকারীদের ওপর পড়ে। প্রতিটি দিন, বছরের পর বছর। সেই দিক থেকে আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে লতিফুর রহমানের মতো একজন উদ্যোক্তাকে পেয়েছিলাম।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে এটা একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে একজন ব্যক্তিই ডেইলি স্টার প্রথম আলোর মতো দুটি স্বাধীন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। লতিফুর রহমানের এই উদ্যোগ রাষ্ট্র, বাক্‌স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য মূল্যবান এক অবদান। আমি ও মতিউর রহমান দৃঢ়ভাবে সেই উত্তরাধিকার বহন করার প্রতিজ্ঞা রাখি। আমাদের সাংবাদিক সহকর্মীরাও তাতে বিশ্বাসী।

এবার আসি লতিফুর রহমানের দেশপ্রেম প্রসঙ্গে। সারাক্ষণ তাঁর মুখে একটা কথা লেগে থাকত যে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু তা-ই নয়, তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আর আমাদের কর্তব্য হলো বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রাকে সহযোগিতা করা। আমরা করব সাংবাদিকতার ক্ষেত্র থেকে, তাঁর মতো লোকেরা করবেন অর্থনৈতিক উদ্যোগের দিক থেকে।

এটা লতিফুর রহমানের শুধু একটা আবেগময় বক্তব্য ছিল না। তিনি এটা বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর সব কাজে এর প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করতেন। পিৎজা হাট ও কেএফসির কথাই বলি। আন্তর্জাতিক ফ্র্যাঞ্চাইজি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্বপ্ন ছিল যে বাংলাদেশে এর আউটলেটগুলো যেন এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠতম হয়। দক্ষিণ এশিয়ার পিৎজা হাটের শ্রেষ্ঠ আউটলেটগুলো যে ঢাকায়, এ নিয়ে তাঁর দারুণ গর্ব ছিল।

৩০ বছরের বেশি সময় ধরে যে আমি লতিফুর রহমানের সান্নিধ্য পেয়েছি, সে কারণে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি।

  • মাহ্‌ফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার