১০ অক্টোবর খুব ভোরে হোয়াটসঅ্যাপে এক বার্তা পেলাম—বিরল এক শিল্পপতি রতন টাটার চিরবিদায়। ক্ষুদ্র বার্তাটি হৃদয়ের গভীরে গিয়ে আঘাত করল। মনে পড়ল প্রায় ২১ বছর আগের কথা। টাটার আমন্ত্রণে জামশেদনগরে ভ্রমণ এবং রতন টাটার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপের কথা।
২০০৩ সালের ২ মার্চ বুধবারের কথা। বাংলাদেশ বিমানে আমরা কলকাতা পৌঁছালাম। তখনো দুপুর হয়নি। বিমানবন্দরে অভিবাসন কর্মকর্তা খুঁটিয়ে পাসপোর্ট দেখলেন। ভ্রমণের কারণ জানতে চাইলেন। বললাম, ‘টাটার আমন্ত্রণে এসেছি। টাটা শিল্প গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই আমন্ত্রণ। ৩ মার্চ তাঁর ১৬৬তম জন্মবার্ষিকী।’ ভদ্রলোক উৎসুক চোখে তাকালেন। বললাম, ‘আমরা কয়েকজন সাংবাদিক এসেছি। জানেনই তো টাটা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠান।’ যাতে দ্রুত ছাড়া পাই সে জন্য টাটা নিয়ে আরও কিছু কথা বললাম। আমার কথায় দ্বিমত করলেন কর্মকর্তা। তিনি বললেন, ‘টাটা দ্বিতীয় বৃহত্তম? টাটা এখন দ্য লারজেস্ট।’ আমি বললাম, ‘কেন রিলায়েন্স’? তিনি বললেন, ‘দুই ভাই যেভাবে ঝগড়াঝাঁটি করছে, তাতে এখন আর এক নম্বর নেই।’ আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পাসপোর্ট তুলে দিলেন আমার হাতে।
ইমিগ্রেশন ছাড়তেই দরজার মুখে ‘টাটা স্টিল’ প্ল্যাকার্ড হাতে এক দীর্ঘকায় তরুণীর সাক্ষাৎ মিলল। সপ্রতিভ। ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিলাম। তাঁর নাম শিল্পশ্রী। টাটার শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা। আরেকটু এগোতেই পরিচয় হলো টাটা স্টিলের গৌতম ব্যানার্জির সঙ্গে। তিনি করপোরেট কমিউকেশনস ব্যবস্থাপক।
কলকাতার একটা হোটেলে আমাদের বিরতি-বিশ্রামের ব্যবস্থা হলো। বিকেল চারটায় ট্রেন। হাওড়া স্টেশন থেকে যাত্রা। চমৎকার ব্যবস্থা। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ। আরামকেদারা। আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি নেই। কোনো প্রয়োজন আর অসুবিধা জানানোর উপায় নেই। চিলের মতো ছোবল দিয়ে গৌতম তা লুফে নেন। সেই প্রয়োজন না মেটা পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি নেই। আমরা যে চার–পাঁচ দিন ছিলাম, ছায়ার মতো তিনি আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন। কী আন্তরিকতা আর আতিথেয়তা!
ট্রেনে শিল্পশ্রী বললেন, ‘জামশেদনগর আপনাদের ভালো লাগবে। পরিচ্ছন্ন, সবুজে ঘেরা।’ তাঁর কথা আমি আমলে নিইনি। উন্নত দেশই শিল্পনগরকে দূষণমুক্ত রাখতে পারে না...।
রাত ১১টা নাগাদ জামশেদনগর পৌঁছালাম। রেলস্টেশনের নাম টাটা নগর। টাটার বিশ্রাম ভবনে থাকার ব্যবস্থা হলো। সবার জন্য পৃথক কক্ষ। ছিমছাম। বাহুল্য নেই। ভালো লাগল। রাতের খাবারেও কোনো বাহুল্য ছিল না। বুঝতে দেরি হলো না বিশাল সম্পদের মালিক টাটা শিল্পগোষ্ঠী কী মিতব্যয়ী। আর্থিক শৃঙ্খলা না থাকলে কারও পক্ষেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
বেশ ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। প্রস্তুতি নিয়ে বের হলাম। চওড়া রাস্তা। দুই পাশে সবুজের ছড়াছড়ি। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন। গাড়ির পেছনে কালো ধোঁয়া। সব বাড়ি বাংলো টাইপের। বহুতল ভবন একেবারেই চোখে পড়েনি। একতলা বা দোতলা। সামনে সবুজ বাগান। সবকিছু ছবির মতো। প্রথম আলোর কাইয়ুম ভাই অর্থাৎ আব্দুল কাইয়ুম মুকুল বললেন, ‘আহ শান্তি লাগছে। ঢাকায় উঁচু উঁচু ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে আর শ্বাস নিতে পারছি না।’
সকাল সাড়ে আটটায় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানস্থলে টাটার প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজির ভাস্কর্য। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। আজকের এই টাটার গোড়াপত্তন হয়েছে তাঁরই হাতে। নিষ্ঠা, সেবা আর শ্রম দিয়ে তিনি এই শিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম এই শিল্পকে মহিরূপে বিকশিত করতে সমান দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানস্থলে আলাপ হলো রাজেশ্বর পান্ডের সঙ্গে। তিনি টাটা স্টিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি। এখানে প্রায় ৪৪ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। আর গোটা টাটার কর্মিবাহিনীর সংখ্যা ৫ লাখের বেশি। ২০৪ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ টাটা শিল্প গ্রুপে কখনো শ্রমিক–অসন্তোষের কথা শোনা যায়নি। কী করে সম্ভব? জানতে চাইলে বললেন, ‘এখানে আমরা নিজেদের শ্রমিক মনে করি না। এই প্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ আমরা। কোম্পানি ভালো আয় করলে তার অংশ আমাদের ভাগেও জোটে। রতন টাটা চেয়ারম্যান বটে, কিন্তু তাঁর বিশাল সম্পদ-বৈভব নেই। তিনি ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন।’
কলকাতা থেকে আমাদের সঙ্গে এসেছেন মহাশ্বেতা সেন। তিনি ‘বৈষ্ণবী’র সহযোগী পরিচালক। এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি ভারতে টাটার জনসংযোগের কাজ করে। তিনি বললেন, ‘টাটার সাফল্যের গোপন রহস্য এখানেই। তাঁরা সম্পদকে নিজেদের পরিবারের বিত্ত মনে করেন না। যে সমাজের কাছ থেকে তাঁরা নিচ্ছেন, সেই সমাজকেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন।’ কিছু পরই তাঁর এ মন্তব্যের সত্যতা মিলল। টাটা যেসব সামাজিক কল্যাণধর্মী কাজ করে, তার কিছু কিছু নমুনা দেখানো হলো আমাদের।
আলাপের একপর্যায়ে বললেন, ‘মুনাফা নয়, সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই আমরা শিল্প করছি।’ জানতে চাইলাম‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন কেন’? জবাবে বললেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে যদি কিছু করা যায়, সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে।’
আলাপ হলো সমাজসেবা ও পারিবারিক উদ্যমের প্রধান কর্মকর্তা শক্তি শর্মার সঙ্গে। জামশেদজির নামানুসারে নাম হয়েছে এই নগরের। জামশেদনগর ঝাড়খন্ড প্রদেশেরই একটি শহর। এটি আগে ছিল বিহার রাজ্যে। ভারতের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যপীড়িত রাজ্য। এই রাজ্যের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে টাটার কত যে উদ্যোগ, তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না।
ইস্পাতের মতো কঠিন শিল্প নিয়ে যাঁরা নাড়াচড়া করেন, তাঁদের ইস্পাতের নিচে যে এ রকম একটা কোমল হৃদয় থাকতে পারে, তা ভাবাই যায় না। আদিবাসীদের জন্য রয়েছে শিক্ষামূলক কর্মসূচি, স্বাস্থ্য কর্মসূচি, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি। শক্তি শর্মা এসব কর্মসূচির বর্ণনা দিতে দিতে বললেন, ‘বাংলাদেশ অবশ্য ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির পথপ্রদর্শক।’ ড. ইউনূসের নাম উঠতেই অজান্তে তাঁর হাত উত্তোলিত হলো। তিনি সালাম জানালেন ড. ইউনূসকে। বললেন, ‘তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।’
টাটার বাংলাদেশ অফিসের প্রধান হিসেবে আগামী মাসে দায়িত্ব নেবেন মানজের হোসেন। নৈশভোজের অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রশ্ন করলাম ‘কী করে আপনারা এই শহরটাকে এভাবে ছবির মতো করে রেখেছেন? কোথায় এর প্রাণশক্তি?’ তিনি বললেন, ‘আমাদের প্রাণশক্তি জামশেদজি। সেন্টার ফর এক্সেলেন্সে তাঁর নিজের হাতের লেখা যত্ন করে সংরক্ষণ করা আছে। তিনি তাঁর উত্তরসূরির উদ্দেশে লিখে গেছেন।’
১৯০২ সালে জামশেদজি তাঁর পুত্র দারবিজকে এই উপদেশবাণী দেন শিল্পনগরী স্থাপনের ছয় বছর আগে। তাঁর এই হিতোপদেশের বাংলা হচ্ছে এ রকম—‘শিল্পকারখানা করার আগে অবশ্যই প্রশস্ত রাস্তার জন্য জায়গা ছেড়ে দেবে। আর ওই রাস্তার দুই পাশে ছায়াদানকারী গাছ লাগাবে। এর ফাঁকে ফাঁকে লাগাবে একটি করে দ্রুতবর্ধনশীল গাছ। উন্মুক্ত জায়গা আর বাগানের জন্য প্রচুর জমি ছেড়ে দেবে। ফুটবল, হকি ও পার্কের জন্য বিশাল এলাকা সংরক্ষণ করে রাখবে। মসজিদ, মন্দির আর গির্জার জন্য পৃথকভাবে জায়গা রাখবে।’
সকালের অনুষ্ঠানস্থলে সামনের সারিতে আসীন ছিলেন টাটার বর্তমান চেয়ারম্যান রতন টাটা। আমি গিয়ে পরিচিত হতেই সোফায় তাঁর পাশে আসন গ্রহণের জন্যে আহ্বান জানালেন। আলাপের একপর্যায়ে বললেন, ‘মুনাফা নয়, সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই আমরা শিল্প করছি।’ জানতে চাইলাম‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন কেন’? জবাবে বললেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে যদি কিছু করা যায়, সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে।’ জামশেদপুরে অর্থনৈতিক উন্নতি দেখে তাঁর এই মন্তব্য হৃদয় থেকে এসেছে বলে মনে হলো।
(স্মৃতিচারণামূলক লেখাটি ইউপিএল থেকে প্রকাশিতব্য রয়টার্সের দিনগুলো বই থেকে নেওয়া হয়েছে।)
সিরাজুল ইসলাম কাদির রয়টার্সের সাবেক ব্যুরোপ্রধান এবং বর্তমানে অ্যামচ্যাম জার্নালের সম্পাদক