‘মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি,
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ান ফুল-মালঞ্চ ধরি।’
‘প্রতিদান’ কবিতায় পল্লিকবি জসীম উদ্দীন প্রহর্তার প্রতি আপন মনোভাব এভাবেই ব্যক্ত করেছেন। গত সোমবার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড, লাঠিপেটা, রাবার বুলেটের জবাবে মঙ্গলবার বন্দুকের নলের সামনে ফুল নিয়ে বসে পড়েন শিক্ষার্থীরা। নিপীড়িত সহপাঠীদের মর্মব্যথা বুকে চেপে ফুল হাতে ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়িয়েছেন তারা। চেয়েছেন নিরাপদ ক্যাম্পাস, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ।
বেগম সিরাজুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজা ও সহকারী প্রাধ্যক্ষদের পদত্যাগ, অবিলম্বে হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ছাত্রীবান্ধব ও দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগ দেওয়ার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন এখন রূপ নিয়ে একদফা দাবিতে। সেটি হলো, শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ।
১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ বিরুদ্ধে বাংলার জনতা গড়ে তোলে দুর্বার গণ-আন্দোলন। শহীদ আসাদ ও সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। ১৮ ফেব্রুয়ারি আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী শহর অভিমুখে মিছিল নিয়ে কাজলা গেটে পৌঁছালে আটকে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
সেদিন শিক্ষার্থীদের গুলি করতে উদ্ধত পাক হায়েনাদের বন্দুকের প্রথম বুলেট ভেদ করে অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহার উষ্ণ হৃদয়। ‘ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’- ড. জোহা তার এ কথা রেখেছিলেন। ঢাল হয়েছিলেন তার শিষ্যদের রক্ষায়।
সেই থেকে ৫২ বছরে দৃশ্যপট অনেক বদলেছে। শিক্ষার্থীরা তর্কসাপেক্ষ কারণে জাতীয় কিংবা গণ-আন্দোলনে আগ্রহ হারিয়েছেন। শামসুজ্জোহার ছায়াও অধরা শিক্ষকদের মাঝে। তৈরি হয়েছে বিশাল শূন্যতা।
সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় সেটা ফুটে উঠেছে দৃষ্টিকটুভাবে। উপাচার্য, প্রক্টর, প্রাধ্যক্ষ পদগুলোতে যেন লেগে আছে কাঁঠালের আঠা। অযোগ্য ব্যক্তিরা এসব পদে আসীন হন, নাকি পদাসীনরা প্রচলিত নোংরা প্রথায় থিতু হতে গিয়ে খেই হারান? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। প্রশাসক হতে গিয়ে শিক্ষকসত্ত্বা হারাচ্ছেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা। মানবিক, স্বচ্ছ ও যৌক্তিক দাবিতেও খুঁজে পান ষড়যন্ত্রের গন্ধ। তাতেই অন্ধ হয়ে ভরসা হারান নিজের ওপর। শিক্ষার্থীদের ভাবেন প্রতিপক্ষ। ক্যাম্পাস হয়ে উঠে শক্তিপ্রদর্শনের ময়দান।
বিগত বেশ কয়েক’বছর ধরে দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে এ সংস্কৃতি বেশ বিকশিত হয়েছে। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) সাবেক উপাচার্য ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিনও একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, পুলিশ পাহারায় পুলিশ জিপে ছেড়েছিলেন ক্যাম্পাস। গল্পটা ভিন্নও হতে পারত। অশ্রুসিক্ত নয়নে, ভালোবাসার অমোঘ বন্ধনে বিদায় জানাতে পারতেন শিক্ষার্থীরা। সংগত কারণেই হয়েছে তিক্ত ছাড়াছাড়ি। এ সংস্কৃতি অশুভ। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোর আকাশে জমে থাকা কালো মেঘগুলো তাড়াতে একটা দমকা ঝোড়ো হাওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
শিক্ষার্থীরা আজ বড্ড অনিরাপদ। ক্যাম্পাস কিংবা সড়ক, কোনোটাই অনুকূলে নেই। এরা রাস্তায় গাড়িচাপায় পড়ে, রাজনৈতিক দাবার গুটি হয়, নিজের ক্যাম্পাসে শিকার হয় বর্বরতার। কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা লকডাউনের পর পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে আন্দোলনের মতো ন্যায্য দাবিতেও মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখেছে শিক্ষার্থীরা। সবশেষে সিলেটের ঘটনায় হতবাক পুরো দেশ। নিন্দার ঝড় উঠেছে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেসব শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের পুলিশের হাতে তুলে দেন, সমস্যা সমাধানের জন্য কঠিনতম পথ বেছে নেন তারা কোনোভাবেই শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারেন না। তাদের সমন্বয়ে গঠিত প্রশাসন ও নৈতিকভাবে স্খলিত হয়ে বৈধতা হারিয়েছেন শিক্ষার্থীদের কাছে।
কাজেই, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফেরাতে অনতিবিলম্বে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কার্যকর সমঝোতা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হোক নব জ্ঞান সৃজন ও অভিনব সৃজনশীলতার স্বর্গে। গুরু শিষ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠুক শ্রদ্ধা, আস্থা ও পরম বিশ্বস্ততায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দুই উপাদানের সেতুবন্ধন মুছে দিক কালো অতীত। ড. জোহা ফিরে আসুক আমার শিক্ষকের মাঝে। বন্দুক নয়, ক্যাম্পাস হোক পুষ্পের।
মাহমুদুল হাছান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি