কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্ব পর্যুদস্ত। এ জন্য খুব বেশি আনুষ্ঠানিকতা না থাকলেও মুজিব বর্ষ বাঙালির হৃদয়ে প্রোথিত। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর দিন ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ১৭ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত মুজিব বর্ষ হিসেবে আমরা পালন করছি। একই সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতার বিকল্প নেই। নিয়মতান্ত্রিক ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি ধাপে ধাপে স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে গেছেন। ৫২–এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪–এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২–এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬–এর ছয় দফা আন্দোলন ছিল মূলত স্বাধীনতার প্রস্ততিপর্ব। ৬৯–এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০–এর নির্বাচনে বিজয় লাভের মধ্যে দিয়ে বাঙালি চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিকে অগ্রসর হয়।
’৭০–এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ত্বরান্বিত করে। পাকিস্তানিরা আলোচনার নাম করে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন যে কী হতে যাচ্ছে। এ কারণে তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মূলত স্বাধীনতারই ডাক দেন এবং ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে বলেন। ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ইউনেসকো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তিনি এ ভাষণে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে দেন যে পাকিস্তানিরা আক্রমন করলে কী করতে হবে। এই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়েই দেশের সমগ্র মা্নুষ মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পিলখানা থেকে তৎকালীন ইপিআরের সদস্য জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়্যারলেসে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেপ্তার করে।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রায় ১ লাখ সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বঙ্গবন্ধু কবে দেশে ফিরে আসবেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে আমাদের বিজয় পূর্ণ পায়।
পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু মোট ৩ হাজার ৫৩ দিন (৩০৫৩ দিন) জেলে কাটিয়েছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন দুবার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের কাছে নতি স্বীকার পাকিস্তান সরকার ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন। সকাল থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে লাখো মানুষ জমায়েত হয়। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ-বাতাস। মূলত বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংহত হয়। বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে আসেন এবং দেশবাসীর উদ্দেশ ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। ...বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে; আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম ফাঁসির কাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না।’
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে।
মো. শরীফ মাহমুদ সরকারি কর্মকর্তা।