ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চ অভিযান- ১০ এর ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের নৌপথে নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। আমাদের দেশে অতীতেও লঞ্চে অগ্নিদুর্ঘটনা এবং ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে এমন মর্মান্তিক ভয়াবহ এবং বীভৎস ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ দেখেনি। নিজের বেঁচে থাকার জন্য যেমন আহাজারি ছিল, তেমনি পরিবারের সঙ্গীকে কিংবা অন্যান্য সদস্যকেও বাঁচানোর জন্য গগনবিদারী আর্তচিৎকার ছিল। পিতা নিরাপত্তা দিতে পারেনি শিশুসন্তানকে, যুবক সন্তান নিরাপত্তা দিতে পারেনি বয়স্ক পিতা-মাতাকে, মা আগলে রাখতে পারেননি তার বুকের শিশুকে কিংবা স্বামী তাঁর স্ত্রীকে। বেঁচে থাকার জন্য সেদিনের এই বাস্তবতা বড় কঠিন এবং ভয়ংকর ছিল। এমন বীভৎস দৃশ্যের কথা আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করা বড় কঠিন।
এই ঘটনায় প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এসবের জন্য দায়ী কে! দায়ীদের খুঁজে বের করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে লঞ্চের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য সবকিছু তদারকি হয়েছিল কিনা। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল কিনা? যন্ত্র থাকলে তো হবে না সেগুলো কার্যকর ছিল কিনা, তাও দেখতে হবে। লঞ্চ পরিচালনায় যারা নিয়োজিত থাকেন তারা এই বিষয়টি কখনোই মাথায় রাখেন না। মূলত ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী তোলা, ফিটনেসবিহীন পরিবহন এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতাই হচ্ছে লঞ্চ দুর্ঘটনার মূল কারণ।
বরগুনা জেলায় আমার জন্ম বলে আমাদের প্রতিনিয়ত ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নৌপথে। শৈশব থেকে যে কথাটি শুনে এসেছি, ‘ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’ সেটির বাস্তব প্রমাণ দেখা যায় নৌ পরিবহন ব্যবস্থায়। অনেক ক্ষেত্রেই অসাধু কর্মকর্তা ও লঞ্চমালিকদের লোভ লালসার তাড়নায় ত্বরান্বিত হয় সেখানে। বিবেকের মানদণ্ড আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা ভাবতে সত্যিই অসহায় লাগে। অসহায় লাগে এই কারণেই যে, নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ কী কারণে কীভাবে ফিটনেসবিহীন রুট পারমিট সার্টিফিকেট দিলেন সেটা আজ ভাববার বিষয়।
অভিযান-১০ লঞ্চটি আয়তনে বড় ও দেখতে চাকচিক্যময় হলেও মূলত তা ছিল ফিটনেসবিহীন একটি নৌ-পরিবহন। একটি পরিবহনের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে ইঞ্জিন। এসব দূর পাল্লার নৌপথে ব্যবহার হচ্ছে রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন ফলে কিছু দূর যেতে না যেতেই লঞ্চগুলো থেমে যায় আবার কখনও কখনও ওই রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন থেকে কালো ধোঁয়া এবং বড় বড় শব্দ বের হয়। এসব ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সদরঘাট থেকে প্রতিদিন ছেড়ে যায় এমন অনেক লঞ্চ। এসব জেনেও নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ তাদের রুট পারমিট দিচ্ছে।
মনে পড়ে গত ১৪ আগস্ট, পরের দিন জাতীয় শোক দিবস পালন করতে নিজ এলাকায় উপস্থিত হওয়ার জন্য আমি এই লঞ্চের যাত্রী হয়েছিলাম। ঢাকা থেকে সেদিন ছেড়ে আসা বরগুনাগামী যাত্রীবাহী অভিযান-১০ রাজাপুরের বিষখালী নদীর কাছে আসতেই হঠাৎ লঞ্চটি আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পরে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ জানান দেয়, যে লঞ্চটি ডুবোচরে আটকে গিয়েছে এটি আর যেতে পারবে না। আমরা কয়েকজন যাত্রী বললাম, জোয়ার আসলে তো লঞ্চটি আবার চালু করতে পারবেন কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ জানাল, ইঞ্জিন একটু সমস্যা হয়েছে। ওই সময়ে প্রায় সাড়ে চার শত যাত্রী ছিলেন। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। আমাদের যাত্রীদের তীরে ওঠার কিংবা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বিকল্প কোনো পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করেনি। তখন নারী-শিশু বৃদ্ধ অসুস্থ রোগী যে যার মতো করে আমরা লঞ্চ থেকে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেদিনের কয়েক ঘণ্টার সেই কষ্টটা আমি এখনো ভুলতে পারি না।
অগ্নিদুর্ঘটনার ট্র্যাজেডিতে আমরা জানতে পারছি, অন্যের লঞ্চের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল অভিযান-১০। নৌ-পরিবহনের যে সুবিধাগুলো কিংবা যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য যে সব ব্যবস্থা থাকা দরকার অধিকাংশই ক্ষেত্রেই তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ছিল, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যন্ত্র থাকলে হবে না সেগুলো কার্যকর ছিল কিনা তাও দেখার বিষয়। একই সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রুও কখনোই নিয়োগ দেওয়া হয় না। সর্বশেষ কবে ফায়ার ড্রিল হয়েছে সেটিও কেউ জানে না। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট যা কখনোই আশানুরূপ চোখে পড়েনি। নিরাপত্তাকর্মী কিংবা দক্ষ জনবল লঞ্চ মালিক কখনোই নিয়োগ করেননি।
নৌ দুর্ঘটনা বড় ধরনের প্রাণহানি হলেও শাস্তির বিধান নামমাত্র বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিশেষজ্ঞরা আবার এমনও মনে করছেন, ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আইন ও অধ্যাদেশের ধারা সংশোধন করা সময়ের দাবি। অতীতের মতো মামলায় বিচারকার্যের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ১০ বছরেও মামলা রায়ের মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই। কেননা মামলার সাক্ষীদের সঠিক নিয়মে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে হ্যান্ডেলিং করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে নিহতের আত্মীয়-পরিজন পরিবারের সঙ্গে আসামিদের আপস হয়ে যায়, ফলে সাক্ষীদের আদালতে আনতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্রপক্ষ।
নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, দায়িত্ব অবহেলা, অব্যবস্থাপনা এবং রুট পারমিট দেওয়ার অনিয়মের কারণে কতগুলো নিরীহ মানুষ প্রাণহানি ঘটল। যারা সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে তারা যে পর্যায়ের হোক, যে দলেরই হোক, যত বড় ক্ষমতার অধিকারী হোক সকলকে বিচারের আওতায় আনা উচিত। একদিন হয়তো ভুলে যাব আমরা এই দিনের স্মৃতি। কিন্তু যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে চিরদিনই।
এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত ও বিচার হোক আমরা চাই। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের যথাযথ ক্ষতিপূরণ বুঝিয়ে দেওয়া হোক।
ফাতিমা পারভীন নারী ও শিশু অধিকার কর্মী এবং পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান