স্থানীয় সরকার বিষয়ে এক সংজ্ঞায় বলা আছে, ‘স্থানীয় সরকার সেই সব কার্যাবলি সম্পাদন করে, যেগুলো বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ এবং এলাকাটি সমগ্র দেশের তুলনায় ক্ষুদ্র।’ অন্যভাবে বলা যায়, স্থানীয় কাজের জন্যই ‘স্থানীয় সরকার’ কার্যকর থাকে। স্থানীয় নির্বাচনে কে যোগ্য, কে অযোগ্য; কে বেশি অভিজ্ঞ, সেসব বিষয়ে স্থানীয়দেরই বেশি জানার কথা। অতীতে তাই ছিল। বহু সমাজসেবী লোক আছেন, যাঁরা রাজনীতি করা পছন্দ করেন না; কিন্তু স্থানীয় এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নির্বাচন করতেন। বহু প্রার্থীকে সর্বদলীয় ভোটে নির্বাচিত হতেও দেখা গেছে। তখন বলা হতো, এবার নির্বাচনে অমুক দল সমর্থিত প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। আঞ্চলিকতা, স্থানীয়তা, আত্মীয়তা ইত্যাদির কারণে স্থানীয়তে এক ধরনের নির্দলীয় পরিবেশ থাকত। অন্যভাবে বলা যায়, স্থানীয়তে মানুষ গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়েই বসবাস করত।
কিন্তু এখন সবকিছু দলীয়করণ হওয়ায় নির্দলীয় সমাজসেবীদের কোনো সুযোগ থাকছে না। এখন স্থানীয়রা দলীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘকালের অসাম্প্রদায়িক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব কারণে। একটি নর্দমা পরিষ্কার রাখা, রাস্তাটি সংস্কার করা, প্রয়োজনীয় সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করা, এসব তো দলীয় বিষয় নয়। এসব কাজ যিনি সুষ্ঠুভাবে করবেন, মানুষ তাঁকেই ভোট দেবেন। যাঁরা কথায় কথায় উন্নত বিশ্বের উদাহরণ দেন, তাঁরা ভুলে যান যে সেখানে স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বহুকাল আগে থেকেই বিদ্যমান রয়েছে। কার্যকর স্থানীয় সরকারের কারণেই সেখানকার ‘জনগণ’ নাগরিক শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
বাংলাদেশে অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত সরকারব্যবস্থা বহাল থাকায় স্থানীয় সরকারগুলো বরাবরই কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পূর্ণ আজ্ঞাবহ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। তবে অতীতে স্থানীয় সরকারের যতটুকু ক্ষমতা ছিল, বর্তমান ব্যবস্থায় ততটুকুও আর থাকছে না। ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ইতিমধ্যে বলেছেন, তৃণমূলের বাছাই করা প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মনোনয়নবঞ্চিত বহু প্রার্থী গণমাধ্যমকে বলেছেন, কেন্দ্রে মনোনয়ন–বাণিজ্য হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন, ‘মনোনয়ন–বাণিজ্য সহ্য করা হবে না।’ এবার নির্বাচনে নাসিরনগর এলাকায় এমন দুজন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, যাঁদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হওয়ায় তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। শোনা গেছে, তাঁদের মনোনয়ন দেওয়ার পেছনে তৃণমূলের কমিটির সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জড়িত রয়েছেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল কমিটিও মনোনয়ন–বাণিজ্যে জড়িত হয়ে পড়ছে।
স্থানীয় সরকারের প্রার্থীরা স্থানীয় উন্নয়নের চিন্তা মাথায় নিয়ে নির্বাচন করছেন না। তাঁরা জাতীয় রাজনীতি মাথায় নিয়ে মুখে স্থানীয় উন্নয়নের কথা বলছেন। এ অবস্থায় এ দেশের আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে দুই ধরনের সরকারব্যবস্থা (তথা জাতীয় সরকারব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা) এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দুই প্রকারের কমিটির (জাতীয় কমিটি ও স্থানীয় কমিটি) চিন্তা করা যেতে পারে। জাতীয় কমিটির সদস্যরা জাতীয় বা কেন্দ্রীয় রাজনীতি নিয়ে তৎপর থাকবেন। জাতীয় কমিটি ‘জাতীয় সংসদ সদস্য’ প্রার্থীদের নাম বাছাই করবেন। স্থানীয় বা তৃণমূল কমিটির সদস্যরা স্থানীয় উন্নয়নের বিষয়ে মনোযোগী থাকবেন। তাঁরা স্বাধীনভাবে স্থানীয় প্রার্থীদের নাম বাছাই করবেন। স্থানীয় কমিটির সদস্যরাও একটি পর্যায় অতিক্রম করে জাতীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
এখানে একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনের কমিটি গঠন করেন না। তা ছাড়া নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নচিন্তা বাদে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন চিন্তাও করেন না। এ দেশের রাজনীতিতে নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায় কোথাও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেনি। সে জন্য একই সঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয়তে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নিতে হবে।
মোশাররফ হোসেন মুসা স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক।