ক্লাস লেকচার শোনার সময় নোট করা, গাড়ি চালানোর সময় কারও সঙ্গে কথা বলা, টিভি দেখার সঙ্গে সঙ্গে খাবার খাওয়া, মিটিং চলাকালে কাউকে ই–মেইল পাঠানো, চা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করা, রান্না করার সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে প্রিয়জনকে পাল্টা মন্তব্য দেওয়া, দৈনন্দিন এ রকম হাজারো উদাহরণের সাক্ষী হই আমরা। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে আমরা একই সময়ে একের অধিক কাজ করে অভ্যস্ত, যা মাল্টিটাস্কিং হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে চারদিকে মাল্টিটাস্কিংয়ের ধারণা প্রচণ্ড ব্যাপকতা লাভ করেছে। এ যুগে তথ্যবহুলতার ভালোর পাশাপাশি খারাপ দিক বলা চলে তথ্যবহুলতা আমাদের একাগ্রতা ব্যাহত করে। ফলে আমাদের ‘অ্যাটেনশন স্প্যান’ বা মনোযোগের দৈর্ঘ্য এমনিতেই অনেক কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি আমাদের মস্তিষ্ককে মাল্টিটাস্কিংয়ের মাধ্যমে প্রভাবিত করি, এতে কাজ করার ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই আরও কমে আসবে। এখন কাজের উৎপাদনশীলতা বা সৃষ্টিশীল মনন বিকাশে মাল্টিটাস্কিংয়ের ভূমিকা আদৌ কতটুকু কার্যকর?
সম্প্রতি সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দাবি করেছেন, যাঁরা মাল্টিটাস্কিংয়ে অভ্যস্ত, তাঁদের মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের সিঙ্গুলার কর্টেক্সের ঘনত্ব উল্লেখজনক হারে কমতে শুরু করে। ফলে মানুষের স্বাভাবিক আবেগ ও উত্তেজনা ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। এ বিষয়ে মার্কিন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ কেপ কি লোহ বলেন, মাত্রাতিরিক্ত ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের অভ্যাস ক্রমে বাড়ার ফলে মাল্টিটাস্কিংও গুরুতর হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিন শেষে সর্বাঙ্গীণ ক্ষতিস্বরূপ মানবমস্তিষ্কের গঠনগত বিকৃতি ও চিন্তাধারা প্রভাবিত হচ্ছে। শরীরবিজ্ঞানের সংজ্ঞামতে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে মানবমস্তিষ্ক একটি কাজের ওপরই ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে পারে। বিপরীতে একাধিক কাজে লিপ্ত থাকলে কোনো কাজই আশানুরূপ ভালো মানের হয় না। এ ছাড়া মাল্টিটাস্কিংয়ে লিপ্ত মানবমস্তিষ্কের আইকিউ লেভেলও ক্রমে দুর্বল হওয়ার দিকে ধাবিত হয়, যা জানা গেছে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায়।
তবে কি মাল্টিটাস্কিং একেবারেই পরিত্যাজ্য? আমাদের বর্তমান ব্যস্ত জীবনে চাইলেও মাল্টিটাস্কিং পুরোপুরি এড়িয়ে চলা অসম্ভব?
উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০ জন স্নাতক শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মুঠোফোনে কথা বলার সঙ্গে ভালোভাবে ড্রাইভিং করতে পারে, অর্থাৎ মুষ্টিমেয় কজন একাধিক কঠিন কাজ একসঙ্গে করার ক্ষমতা রাখেন। গবেষকেরা অনুমান করে বলছেন যে জিনগতভাবে এসব সুপারটাস্কারের ব্রেন খুবই ব্যতিক্রম। পাশাপাশি দৈনন্দিন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজগুলো একটা একটা করে করার জন্য যে বাড়তি সময় দরকার, হয়তো সেটা অনেকের জন্যই বিলাসিতা। তাই কাজের গুরুত্ব বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত যে মাল্টিটাস্কিং করবেন কি না। তাহলে ব্যক্তিজীবনে মাল্টিটাস্কিংয়ের অবস্থান কোথায়? মাল্টিটাস্কিংয়ের প্রতি সত্যিই কি উৎসাহী হওয়া উচিত? এ প্রশ্নের জবাবে সরাসরি হ্যাঁ বা না বলাটা বেশ মুশকিল।
মাল্টিটাস্কিংয়ে যদি মানসিক চাপ বেড়ে যায়, তাহলে বিষয়টি অবশ্যই দুশ্চিন্তার। সৃজনশীলতা বৃদ্ধিকল্পে মাল্টিটাস্কিংয়ে যদি মানসিক স্থিরতাই না থাকে, সে ক্ষেত্রে তা করা একেবারেই মানানসই নয়। বিপরীতে যদি একাধিক কাজ করার দক্ষতা অর্জন করে থাকেন, তাহলে মাল্টিটাস্কিং বেছে নিতে পারেন। অন্যত্র মাল্টিটাস্কিং এলোমেলো অবস্থার সম্মুখীন করলে, হাতে থাকা কাজগুলোকে ক্রমান্বয়ে শেষ করাই শ্রেয়। কারণ, ক্ষেত্রবিশেষে মাল্টিটাস্কিং মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। সর্বোপরি, আমাদের একটা বিষয় সচেতন থাকা প্রয়োজন যে প্রতিযোগিতাটা অন্যের সঙ্গে নয়; বরং নিজের সঙ্গে নিজের। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য থাকা উচিত নিজের আপন সত্তার সেরা সংস্করণ করা।
মারুফ মজুমদার
শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।