বইমেলা: সৌজন্য কপি পাওয়ার আশায় থাকবেন না
বছর ঘুরে আবারো এলো ফেব্রুয়ারি মাস। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস এবং বইয়ের মাস। লেখক-প্রকাশক এবং পাঠকের মাস। মেলা প্রাঙ্গণে বইয়ে ঠাসা শত শত প্যাভিলিয়ন, হাজারো নতুন বই ও লাখো পাঠকের উপস্থিতিতে রমরমা হবে বইমেলা। বাংলা সাহিত্য পাবে নতুন সম্পদ, সাহিত্যের ইতিহাস পাবে আগামীর লেখক। যাঁদের অল্পবিস্তর পড়ার বাতিক আছে, তাঁদের কাছে ফেব্রুয়ারি আকাঙ্ক্ষিত। নতুন বইয়ের গন্ধ, লেখক-পাঠকদের মিলনমেলায় এক অনবদ্য আয়োজন।
একজন লেখকের কাছে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সন্তানসম। মাতৃত্ব-পিতৃত্বের মায়ায় সন্তান ভূমিষ্ঠের ফলে যেমন রোমাঞ্চিত আনন্দের রোমন্থনের স্রোত সৃষ্টি হয়, তেমনি একজন লেখক সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মাতোয়ারা হতে পারেন তাঁর চিন্তাকে দুই মলাটের ভাঁজে বন্দী করে।
ফেব্রুয়ারির একুশে বইমেলায় আমাদের অসংখ্য বন্ধুর প্রথম কিংবা প্রাথমিক লগ্নের সৃষ্টি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে শুনে আমরা হয়তো অপেক্ষা করছি বন্ধুত্বের খাতিরে সৌজন্য কপি পাওয়ার আগ্রহে।
ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আমাদের অসংখ্য বন্ধুর প্রথম কিংবা প্রাথমিক লগ্নের সৃষ্টি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে শুনে আমরা হয়তো অপেক্ষা করছি বন্ধুত্বের খাতিরে সৌজন্য কপি পাওয়ার আগ্রহে। অর্থের বিচারে এটা সংকীর্ণ না হলেও চিন্তার বিচারে একজন লেখককে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য এটা মারাত্মক টনিকের কাজ করে। প্রকাশনাশিল্প সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা অবশ্যই অবগত যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নতুন কোনো লেখকের পাণ্ডুলিপি অর্থ ছাড়া প্রেসে যায় না, মলাটবদ্ধ হয় না।
উদাহরণস্বরূপ বলি, মাত্র ১০০ কিংবা ততোধিক মূল্যের একখানা বই কিনতে আপনাকে কোনোভাবেই বেগ পেতে হয় না, কিন্তু একজন লেখককে যদি তাঁর শতাধিক বন্ধু, সহপাঠী এবং অগ্রজ-অনুজকে সৌজন্য কপি বিলিয়ে খুশি রাখতে হয়, তবে তাঁর ইচ্ছাশক্তি মুকুলেই ধাক্কা খায় এবং অমিত সম্ভাবনার ইতি ঘটার আশঙ্কা জাগ্রত হয়।
মনে রাখা উচিত, ইতিহাসের কোনো পরতেই সাহিত্যচর্চার সঙ্গে বিত্তবান এবং অভিজাতরা (কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত) সম্পৃক্ত হননি। মধ্যবিত্ত কিংবা গরিব শ্রেণিকেই সাহিত্য টানে। হোক তিনি লেখক হিসেবে কিংবা পাঠক।
অর্থের সীমাবদ্ধতা লেখকদের ছিল, আছে এবং থাকবে বলেই ইতিহাসস্বীকৃত সত্য। কাজেই একজন লেখককে পরিপূর্ণ বিকশিত হওয়ার সুযোগ কেবল একজন পাঠকই দিতে পারেন। প্রেরণা ও প্রশংসা সব কাজের গতিকে ত্বরান্বিত করে। লেখকদের ক্ষেত্রে এসব আরও সহায়ক ভূমিকা নেয়।
কাজেই শুধু বন্ধুবান্ধব নয়, বরং স্বজনদের এমনকি মা-বাবা লেখক হলে সন্তানের এবং সন্তান লেখক হলে মা-বাবারও উচিত বই কিনে পড়া। বই কিনে অন্যদেরও উপহার দেওয়া। এতে একদিকে যেমনিভাবে লেখক প্রেরণা পাবেন, তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়বে, তেমনিভাবে লেখারও সঠিকভাবে মূল্যায়ন হবে। কেননা, মুফতে যা পাওয়া যায়, চিরকালই ওসবের প্রতি আমাদের আগ্রহ কম ছিল!
শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বরং তাবৎ বিশ্বের আনাচকানাচে যতগুলো বইমেলার আয়োজন হয়, তার মধ্যে বাংলা একাডেমি আয়োজিত ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির বইমেলা অন্যতম আলোচিত এবং ব্যাপক পরিসরে সুবিস্তৃত। বাংলা ভাষায় এমন বৃহৎ পরিমণ্ডলে এবং তাৎপর্যমণ্ডিত বই ও বইপোকাদের মিলনমেলা আর দ্বিতীয়টি কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। দেশি-বিদেশি লেখকদের নতুন বইয়ের ঘ্রাণে রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাগরণ ঘটে।
ভাষার মাসের বইমেলায় হাজার হাজার নতুন লেখকের সৃষ্টি আলোর দর্শন পায়। পুরোনো কিংবা প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কাছেও বইমেলা যেন নতুন যৌবনের স্পর্শ-অনুভূতি জাগ্রত করে। বইমেলাকে কেন্দ্র করে মৃতপ্রায় প্রকাশনাশিল্পেরও ঘটে বৃহৎ জাগরণ। ছাপাখানাগুলোর দিনরাত এক হয়ে যায়।
আমার ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্বের জগতে এমন শতাধিক লেখক আছেন, যাঁদের এই বইমেলায় প্রথম সৃষ্টি উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। তাদের আনন্দ দেখে অজানা শিহরণে শিহরিত হই। মনে হয় যেন আমিও তাদের সুখের একটা বড় অংশ। তাদের সৃষ্টির পাঠক হিসেবে নিজেকে সাহিত্যের নব্যকান্ডারিদের ভক্ত-অনুরক্ত ভাবতে ভালোই লাগে।
আমার মতো নগণ্য পাঠকের কাছে বইমেলা সর্বদাই বিশাল আবেদনের; হোক সে ফেব্রুয়ারির কিংবা অন্য কোনো পার্বণের। সবার কাছে অনুরোধ, লেখককে প্রেরণা দিন, বই কিনুন। বই পড়ুন, আলোকিত জীবন গড়ুন। লেখকদের জন্য আশার প্রদীপ হোন, নিরাশার পেন্ডুলাম হবেন না। শপথ করুন, সৌজন্য কপি দাবি করবেন না।
রাজু আহমেদ একজন পাঠক
[email protected]