চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, চোরের মায়ের বড় গলা, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই—চোর নিয়ে এসব প্রবাদ যেন বাস্তব রূপ পেয়েছিল বিগত সরকারের আমলে। বাংলাদেশ ছিল যেন এক লুটপাটের আঁতুড়ঘর। বিগত দেড় দশকে টাকা পাচারের স্বর্গরাজ্য ছিল বাংলাদেশ। এ সময়ে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সরকারের অন্তত সাতটি নজরদারি সংস্থা থাকা সত্ত্বেও এই বিপুল অঙ্কের টাকা চলে গেছে বিদেশে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অধিকাংশ স্মার্ট চোরই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বলছে, বৈশ্বিক বাণিজ্যভিত্তিক কারসাজি, হুন্ডি, চোরাচালানসহ নানাবিধ পন্থায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতিবছর ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
অবৈধ অর্থপ্রবাহের ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস—এই ১০টি দেশ বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়। আর অর্থ পাচারের সিংহভাগই হয় বাণিজ্যিক উপায়ে। অর্থ পাচারের মাধ্যমে আর্থিকসহ সব ধরনের অপরাধ লুকানো, কর ফাঁকি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন ও বিনিয়োগ নীতি লঙ্ঘন, অন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ এবং উন্নত দেশের উঁচু মানের জীবনযাত্রার লোভে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ যেন বিগত বছরগুলোতে মামুলি ব্যাপার হয়ে উঠেছে। মূলত বিনিয়োগ ভিসা, স্থায়ীভাবে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বসবাসের অনুমোদন, বিভিন্ন সেকেন্ড হোম প্রকল্প ও নমনীয় বিনিময় হারের ব্যবস্থা বাংলাদেশের নাগরিকদের অর্থ পাচারে উৎসাহিত করছে।
সভ্যতার আদিকাল থেকে শক্তিধর মানুষ তাঁদের ওপর ন্যস্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের লাভে আসীন হয়েছেন। কৌটিল্য তো বলেই গেছেন, মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। রাজা ও তার পর্ষদদের কাজ হলো চুরি ঠেকানো। তবে এ কাজ সহজ নয়। জিবের ডগায় মধু রাখা হলে তা চেখে দেখা যেমন কঠিন, সরকারি অর্থের হাতের নাগালে আসা তেমনই। তাই আমরা অনেক সময় যুক্তি দেখাই, ‘চুরি তো নেতা করেন না, তাঁর পারিষদরা করেন।’ কিন্তু জনগণের অর্থ নিয়ে নয়ছয় হলে তা যেভাবেই হোক, ক্ষতিটা আমাদেরই।
কথায় আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর চোরদের কেউ পালিয়ে বেঁচেছেন, কেউ জেলে গেছেন; অধিকাংশই রয়েছেন আত্মগোপনে। চোর পালালে যেহেতু বুদ্ধি বাড়ে, তাই মনে হয় আমাদের দেশের বুদ্ধিমানেরা চোরদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি; বরং তাঁরা এমন ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে চোরেরা প্রতিপালিত হয় এবং পালাতে সক্ষম হয়।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ টাকা পাচার ঠেকানো এবং পাচার করা টাকা ফেরাতে টাস্কফোর্স পুনর্গঠন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে, আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবদুস সোবহান ওরফে গোলাপ যুক্তরাষ্ট্রে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম কানাডায় অর্থ পাচার করেছেন বলে দুদক তদন্ত করছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশর সম্পদ বিদেশে পাচারকারী স্মার্ট চোরদের চিহ্নিত করা, সম্পদ উদ্ধারে হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করা এবং পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
মো. আনোয়ার হোসেন
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর