শিক্ষকতা একটি ব্রত। একজন শিক্ষক তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিতরণ করে শিক্ষার্থীদের মানবতাবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন। তাই শিক্ষকদের জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়ে থাকে। অথচ এই শিক্ষকেরাই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের শিক্ষকদের বেতন অত্যন্ত কম। ফলে তুলনামূলক মেধাবীরা খুব সহজে এ পেশায় আসতে চান না। আমাদের কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্ত না হওয়ায় এখন নেহাত ঠেকায় পড়েই অনেকে শিক্ষকতা পেশায় আসছেন। বিশেষ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবস্থা একেবারেই নাজুক।
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন সহকারী শিক্ষকের প্রারম্ভিক মাসিক বেতন সর্বসাকল্যে ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে যা দিয়ে একটি সংসারের এক মাসের খরচ চালানো কেবল কষ্টসাধ্যই নয়, বরং খানিকটা অসম্ভবও বটে। তবু জোড়াতালি দিয়ে, ধারদেনা করে চালাতে হয়। এই হিসাব কেবল নিজ বাড়িতে অবস্থান করে আশপাশের কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা একজন শিক্ষকের। কিন্তু যাঁরা নিজ জেলার বাইরে অনেক দূরে চাকরি করছেন, তাঁদের হিসাবটা মিলবে কীভাবে? আগে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ হতো স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে। তখন হয়তো হাজারে দু–চারজন নিজ এলাকার বাইরে চাকরি করতেন। তাই হয়তো তখন বদলি না দিলেও খুব একটা সমস্যায় পড়তে হতো না। কিন্তু নিয়োগ ক্ষমতা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) হাতে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হাজার হাজার শিক্ষক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১০০ কিলোমিটার থেকে ১ হাজার কিলোমিটার দূরের কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তাঁদের অবস্থা তাহলে কী? তাঁদের এই স্বল্প বেতনে ঠিকমতো ১০ দিনও সংসার চালানো সম্ভব নয়। তবু রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতার প্রশ্নে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ অর্থনৈতিক মুক্তি না পেয়ে সংসার চালানোর অঙ্ক মেলাতে না পেরে মানসিক অশান্তির সাগরে হাবুডুবু খাওয়া শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে মানসম্মত পাঠদান ও উন্নত শিখন কার্যক্রম। এ যেন আমাদের গ্রাম এলাকায় বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে প্রচলিত প্রবাদ ‘তেলেও কম, ভাজাতেও মচমচা’–এর নামান্তর। অর্থাৎ উপকরণ কম হলেও জিনিসটি মজবুত হতে হবে। তবু শিক্ষকেরা শত অভাবেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজের সর্বোচ্চটাই দিতে বদ্ধপরিকর।
আমি যে এলাকায় চাকরি করি সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা বুঝতে আমার খানিকটা কষ্ট হয়। বিশেষ করে আমার স্থানীয় সহকর্মীরা যখন মিটিং কিংবা নিজেরা কথোপকথন করেন, তখন কিছুই বুঝতে পারি না। আমি কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। শিক্ষার্থীদের কথা বুঝতে ও বোঝাতেও অনেকটা সমস্যায় পড়তে হয়। স্বাভাবিকভাবেই দূরের ভিন্ন একটি অঞ্চলের সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা কষ্টসাধ্য। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বাইরে থেকে আসা শিক্ষকদের ‘কলুর বলদের’ মতো খাটিয়ে নেয়। পান থেকে চুন খসলেই ঘটে তুলকালাম কাণ্ড। নারী শিক্ষকদের জন্য সংকট আরও বেশি।
তাই দূর জেলায় চাকরি করা শিক্ষকদের বদলি বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠানে আসার সুযোগ দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বদলিপ্রত্যাশী এমপিওভুক্ত শিক্ষক সমাজ আন্দোলন করে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকার বাহাদুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করছে না। অথচ সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি, এনজিও সব চাকরিতেই বদলি ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজ উপজেলাতেই চাকরি করলেও তাঁদের বদলি আছে। বদলি নেই শুধু দুর্ভাগা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের। সরকার এ বিষয়গুলো কি বোঝে না?
প্রফুল্ল চিত্তই পারে শিক্ষকদের উদ্দীপনা জোগাতে। কিন্তু পদে পদে বৈষম্যের শিকার হয়ে কি চিত্তকে প্রফুল্ল রাখা যায়?
একটা গল্প মনে পড়ে গেল, সালমা একজন অনাথ মেয়ে। কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা নেই তার। করুণা করে মাঝবয়সী জামাল মিয়া তাকে বিয়ে করেন। স্বামী তার অনাথ স্ত্রীকে দুবেলা খাওয়ান, পরান। তাই স্বামী তাঁর স্ত্রীকে নিয়মিত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেন আর বলেন সব সময় হাসিখুশি থাকবে। সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলবে। না করলে কিন্তু আরও কঠিন শাস্তি হবে। তোমার আর এ বাড়িতে জায়গা হবে না। স্ত্রীর যাওয়ার জায়গা নেই বলে শাস্তির ভয়ে ও চাপে পড়ে মেকি হাসিটা হাসেন। কিন্তু অন্তরের ক্ষতটা থেকেই যায়। কেননা, তাঁর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাঁকে বাধ্য করা হচ্ছে।
আমরা এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা নামমাত্র বাড়ি ও চিকিৎসা ভাতা পান, শিক্ষা ভাতা নেই। সব মিলিয়ে খুবই স্বল্প বেতন। সব মেনে নিয়ে চাকরি করার প্রত্যয় আমাদের। শুধু দূরের শিক্ষকেরা চেয়ে আসছি বদলি। কিন্তু বদলির বদলে প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রণায় ভোগাচ্ছে। অথচ বদলি আমাদের পেশাগত অধিকার। আবার বলছে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে সুষ্ঠুধারার মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করতে। এটা অনেকটা অসাধ্য সাধন হলেও আমরা চাকরি হারানোর ভয়ে মেনেই নিয়েছি।
দূরের শিক্ষকদের মনে মনে একটা আশা ছিল যে বদলি না দিক, অন্তত চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করে নিজ এলাকায় কিংবা আশপাশের কোনো জেলায় যেতে পারব। কিন্তু সম্প্রতি ১৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ একটি পরিপত্র জারি করে ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর জারি করা পরিপত্রের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদকে সাময়িক স্থগিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইনডেক্সধারীদের গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের পথ রুদ্ধ করে দেয়। বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতে পাচ্ছি, ইনডেক্সধারীদের ইনডেক্স ব্যবহার না করেও আবেদনের সুযোগ দেবে না। কেউ যদি ইনডেক্স ছাড়া আবেদন করেন, তাহলে আগের ইনডেক্স বাতিলসহ শাস্তিও ভোগ করতে হবে। বদলিপ্রত্যাশী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের গৃহবধূ সালমার মতো হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে পাঠদানে বাধ্য করার অভিনব কৌশলে শিক্ষকেরা হতাশ ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। যদিও ওই বিভাগ এ বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করেনি।
অথচ নিরাপদ কর্মস্থল, মানসিক প্রশান্তি আর অর্থনৈতিক সচ্ছলতাই মানসম্মত পাঠদানের প্রধান নিয়ামক। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা দিতে রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতার ব্যাপার নিহিত। অন্তত বদলিপ্রত্যাশী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির আগে আলাদা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ প্রদানের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
মুহাম্মদ আলী
সহকারী শিক্ষক
পূর্ব সন্দ্বীপ ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা
উত্তর মগধরা, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম
নিজ জেলা: কুড়িগ্রাম
ই–মেইল: [email protected]