চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি শিক্ষার্থীবান্ধব হবে কবে?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষ

বই যদি হয় মানুষের অন্তহীন জ্ঞানের আধার, তাহলে বইয়ের আবাসস্থল হলো গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি। গ্রন্থাগারের একেকটি তাকে ঘুমিয়ে থাকে মানুষের হাজার বছরের লিখিত-অলিখিত ইতিহাস। কালের খেয়াঘাট, যেখান থেকে মানুষ সময়ের পাতায় ভ্রমণ করে, অতীত খুঁজে বেড়ায় ও ভবিষ্যতে সেই স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ হয়। লাইব্রেরিতে কী না থাকে! অনেক লাইব্রেরিতে থাকে প্রাচীন শিলালিপি থেকে আধুনিক লিপি পর্যন্ত।

একটি গ্রন্থাগার মানবজীবনকে যেমন পাল্টে দেয়, তেমনি আত্মার খোরাকও জোগায়, উন্নয়নের পথ বাতলে দেয়। তাই গ্রন্থাগারকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে সব সময় ভালো সম্পর্ক থাকে। যার কাছে থাকলে মন ভালো থাকে, মেধা বিকশিত হয় ও নতুন কিছু জানার ইচ্ছা তৈরি হয়। জ্ঞানচর্চা ও বিকাশের জন্যই মূলত গ্রন্থাগারের সৃষ্টি।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি হওয়া উচিত শিক্ষার্থীবান্ধব; অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যা চাইবেন, তা লাইব্রেরিতে থাকতে হবে। কেননা, লাইব্রেরি সৃষ্টি শিক্ষার্থীদের জন্যই।

শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্য পেলেই গ্রন্থাগার তার অস্তিত্ব ফিরে পায়, সজীব হয়। শিক্ষার্থীদের মনের খোরাক মেটাতে না পারলে লাইব্রেরিতে যাওয়ার সদিচ্ছা জন্মায় না। ফলে গ্রন্থাগারকে তার অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির মুখে পড়তে হয়। গ্রন্থাগারই হচ্ছে এমন জায়গা, যেখানে হাজারো অতীত নামক ভালোবাসার মেলবন্ধন মেলে।

আমাদের পাঠাগারে কেন যাওয়া উচিত, তা বিশদভাবে বলতে গেলে, পাঠাগার হলো বই, পুস্তিকা ও অন্যান্য তথ্যসামগ্রীর একটি সংগ্রহশালা; যেখানে পাঠকের প্রবেশাধিকার থাকে এবং পাঠক সেখানে গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধান করতে পারেন।

পাঠাগারের সৃষ্টি হয় মানুষের বই পড়ার আগ্রহের বাতিঘর থেকে। পাঠাগারের বইয়ের পাতায় শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে মানুষের জ্ঞান জমা হয়ে থাকে। সেই জ্ঞান মানুষ ধারণ করে এবং তা জীবনে লালন করে। কিন্তু এমন পাঠাগার দিয়ে কী হবে যে পাঠাগার মানুষের মনের খোরাক জোগাতে পারে না? নিজ দেশের সংস্কৃতিকে লালন করতে পারে না? সময়ের সঙ্গে নিজেকে হালনাগাদ করতে পারে না?

চার লাখ বইয়ে ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি। যদি প্রশ্ন করা হয়, এই পাঠাগারে কী আছে? নানা রকমের বই, পাণ্ডুলিপি, সাময়িকী, সংবাদপত্র, পত্রিকা, উপাত্ত, গবেষণা, বিশ্বকোষ, অভিধান, হ্যান্ডবুক, ম্যানুয়েল, মানচিত্রসহ বিভিন্ন সংগ্রহ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আড়াই শ থেকে এক শ বছরের মধ্যে অনুলিখিত প্রাচীন ভূজপত্র, তানপত্র, হাতে তৈরি তুলট কাগজ, তালপাতা ও বাঁশখণ্ডের ওপর বাংলা, সংস্কৃত, পালি, আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় রচিত পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কর্তৃক সংগৃহীত ১৮৭২ থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে প্রকাশিত প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুরোনো সাময়িকী।

এই লাইব্রেরির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, গবেষণাগার হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই লাইব্রেরিতে কী নেই? তাহলে প্রথম উত্তর আসবে, গবেষণার বিন্দুমাত্র বালাই নেই।

শিক্ষার্থীদের চাকরির উপযোগী বই নেই। শিক্ষার্থীদের ক্রয় করা বই ভেতরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বই খুঁজতে গিয়ে সার্ভারের লোডিংয়ের শেষ নেই!

তাকে তাকে থাকা পুরোনো বইয়ের পাতার ওপর ধুলাবালুর কমতি নেই। এ-বা কম কিসের? শিক্ষার্থীদের কথা শোনে কে? যে লাইব্রেরির তৈরি শিক্ষার্থীদের জন্য, আজ পাঠক হারাচ্ছে সেই পাঠাগারই।

যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের চাকরি পরীক্ষার বই নিয়ে লাইব্রেরিতে প্রবেশ করতে দেয়, সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ নিষেধ করে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের বই নিয়ে লাইব্রেরি ওপরের কক্ষগুলোতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে এই পাঠাগারে পাঠকের সংখ্যা দিন দিন কমছে।

পাঠাগারে যেসব বই রয়েছে, তার বেশির ভাগ পুরোনো, সার্ভারের সমস্যা থাকার কারণে তা ইন্টারনেট থেকে বের করা অনেক সময় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠাগারের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও সমাধান পাচ্ছেন না।

গরমের সময় লাইব্রেরিতে বসে থাকা যায় না। লোডশেডিং হলে তো কষ্ট আরও বেড়ে যায়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার কেন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হবে না?

অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের চাওয়ার মূল্য দিয়ে লাইব্রেরি নতুন করে সাজাতে হবে। নতুবা দিন শেষে আফসোস নিয়ে বলতে হবে, এই লাইব্রেরি শিক্ষার্থীবান্ধব হবে কবে?

রাসেল হোসেন সাকিব
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়