কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে একসময়ের খরস্রোতা ও প্রমত্ত নরসুন্দা নদী। এর আরেক নাম নাগচিনি। অতীতে খরস্রোতা নরসুন্দায় দেশ-বিদেশের সওদাগরি নৌকা এসে ভিড়েছে। স্বচ্ছ ছল ছল জলে ভেসে উঠেছে শহরের প্রতিচ্ছবি। শীতের দিনরাতগুলো মুখর হয়েছে হাজারো পাখির কলকাকলিতে।
এ নদীর তীর ঘেঁষে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ, উপমহাদেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। প্রতিদিন গুরুদয়াল কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আড্ডা দিতে বা একটু মানসিক প্রশান্তির জন্য চলে আসেন নরসুন্দার তীরে। বিভিন্ন উপজেলা থেকে এবং শহরে বসবাসকারী লোকজন একটু প্রশান্তির পরশ পেতে প্রতিদিনই বিকেলে জড়ো হন এ নদীতীরেই।
জনশ্রুতি আছে, অতীতে নরসুন্দার ভয়াল রূপের কারণে মানুষ আঁতকে উঠত। কিন্তু বর্তমানে নদী ভরাট, অবৈধ দখল, মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, কচুরিপানা নরসুন্দার অতীত ঐতিহ্যকে গ্রাস করে ফেলছে। নদীর পানি ছেয়ে গেছে কচুরিপানার কারণে। দেখে মনে হয় সবুজে ঘেরা বিস্তৃত কোনো মাঠ! একসময়ের জোয়ার-ভাটাতে পরিপূর্ণ এ নদীতে এখন পানি চলাচল চোখে দেখা দায়। এ ছাড়া দুই তীরের মানুষের পয়োনিষ্কাশনের সহজ স্থানে পরিণত হয়েছে নদীটি। নদীর বিশাল অংশ চলে গেছে অবৈধ দখলদারদের কবজায়।
নদীটির পাড়েই কিশোরগঞ্জ শহরের তিনটি বিখ্যাত বাজার। এসব বাজারের সব বর্জ্যে সয়লাব হচ্ছে নদীটি। শহরের পূর্বাংশে পাশাপাশি পুরান থানা ও বড় বাজার। উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত ব্রিজ, বাজার দুটিকে সংযুক্ত করেছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলতে ফেলতে নদী তো বটেই, ব্রিজটিও বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। শহরের অন্যতম ব্যস্ততম জায়গা গৌরাঙ্গবাজার ব্রিজ বা বড় বাজার ব্রিজ থেকে নদীটি দেখে যে কারও মন খারাপ হতে পারে। চারদিকে ময়লার স্তূপ আর আবর্জনা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। কিন্তু একসময় এ নদী দিয়ে বড় বড় লঞ্চ, ট্রলার যাতায়াত করত। নদীতে পাওয়া যেত নানা রকমের মাছ। বর্ষার সময়ে পানিতে থই থই করত নদীটি। এখন এসব শুধুই ইতিহাস। ময়লা-আবর্জনায় নদীটি ভরাট হয়ে দিনে দিনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। কচুরিপানা আর ময়লার জন্য পানিপ্রবাহের সামান্য সুযোগও নেই। মাঝেমধ্যে কোথাও ডোবার মতো অল্প পানি জমে আছে। নদী ভরাট করে বসানো হয়েছে অস্থায়ী বাজার। নদীটির অস্তিত্ব এখন পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে। নরসুন্দার অবয়ব থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে নদীর চিহ্ন। কঙ্কালসার অস্তিত্ব নিয়ে শুধু টিকে আছে নদীর নামটি।
কিশোরগঞ্জবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে নদীর ৩৫ কিলোমিটার পুনর্খননের কাজ শুরু হয়ে ২০১৬ সালে শেষ হয়। এ প্রকল্পে ১১০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। তৎকালীন শহরের ভেতর নরসুন্দার ওপর নির্মাণ করা হয় বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন সেতু। কিন্তু পরবর্তী সময় সুষ্ঠু তদারকির অভাবে প্রকল্পের সৌন্দর্য ক্রমে হারিয়ে যায়। নদীর প্রবাহ সামান্য ঠিক হলেও কিছুদিন পরই আবার নদীর পাড়ে কোথাও কোথাও অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠে। পাশাপাশি শহরের প্রায় সব বর্জ্য ফেলা হয় এই নদীতে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল, বাসাবাড়ির অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে পানি দূষিত হয়ে কালো বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে।
নদীর পাড় দিয়ে নির্মিত শহরের বড় বাজার থেকে কাচারীবাজার সেতু পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার ওয়াকওয়েতে (হাঁটার পথ) ময়লা-আবর্জনা ও জবাই করা পশুর বর্জ্যের দুর্গন্ধে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন বাজারের সব ধরনের আবর্জনা এখানে ফেলা হয়। আবর্জনার উৎকট গন্ধে নাক চেপে হাজারো মানুষকে ওয়াকওয়েতে চলাচল করতে হচ্ছে। কেউ একবার এ পথ দিয়ে গেলে দ্বিতীয়বার আর মাড়াতে চান না এ পথ। পৌরসভা ময়লা না ফেলার নির্দেশনা দিয়ে সাইনবোর্ড লাগালেও এর নিচেই ময়লার স্তূপ করে রাখা হয়।
নরসুন্দা এখন কিশোরগঞ্জের দুঃখের কারণও। নদীটির ইতিহাস হয়ে আছে ‘জীবন্ত’ আর বর্তমান হয়ে গেছে ‘মৃত’। কোনোমতে অস্তিত্ব নিয়ে শুধু টিকে আছে কঙ্কালসদৃশ নরসুন্দা নদীর নামটিই। পরিবেশকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর ৩২ কিলোমিটার কয়েক বছরের মধ্যেই একবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। নরসুন্দা নদী তার অতীতের চিরচেনা রূপে ফিরে আসুক, এই প্রত্যাশা করি। এ জন্য জেলা প্রশাসক, পৌরসভা মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
মোহাম্মদ রাজীব
বাটাইল, চৌদ্দশত, সদর, কিশোরগঞ্জ
শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়