জ্ঞান আহরণ করা যদি হয় একটি আশীর্বাদপুষ্ট অর্জন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে তার স্বর্গ। জ্ঞানের জন্য মানুষ আপন নীড় ছাড়ে, বাসা বাঁধে নতুন আলয়ে। সেই নীড় ছাড়া হতে পারে নিজেকে আবিষ্কার করতে, মনোনিবেশ করতে নিজ ধ্যানে। সেই মুক্তচর্চার জন্য অবাধ সুষ্ঠু ব্যবস্থার বিকল্প নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি শিক্ষা এবং গবেষণার প্রতিষ্ঠান যা বিভিন্ন একাডেমিক শাখায় একাডেমিক ডিগ্রি প্রদান করে, শিক্ষার্থীদের নতুন করে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে ও চিন্তা শক্তি বিকাশের অনুরণিত করে। যার জন্য অবকাঠামো থাকতে হবে যেমন উন্নত তেমনি যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির প্রভাবে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল কাজের প্রসার ঘটে।
২৩১২ একর পাহাড়ি ও সমতল ভূমির নিয়ে বিস্তৃত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কমতি নেই; সারা দেশ থেকে আশা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আঞ্চলিকতা ও রীতি-আচার বিনিময়ের শেষ নেই। কিন্তু এত এত থাকার মাঝে মূল জিনিসটিই নেই, সেটি হলো উন্নত শিক্ষা ও গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে কতটুকু বা অবধান রাখছে? কতটুকু বা শিক্ষার্থীদের হয়ে কাজ করছে?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন নিয়ে দুর্ভোগের শেষ নেই। কালের পরাক্রমে শাটল ট্রেনের জন্য পরিবহন খরচ বাড়লেও কমেছে শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ; বেড়েছে শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তা যেন বর্তমানে গরমের সময়গুলোতে হয়ে দাঁড়িয়েছে মহাদুর্ভোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ হাজার পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হল, কটেজগুলোতে থাকলেও ২০ হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করে। যার জন্য চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ কিলোমিটার দূরত্বে শাটল ট্রেনে হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের জন্য অন্যতম মাধ্যম। যাতায়াতের জন্য সড়ক পথ থাকলেও তা সময়সাপেক্ষ ও খরচবহুল।
ক্লাস খোলার দিনগুলোতে দৈনিক সাত বার ট্রেন ক্যাম্পাস থেকে চট্টগ্রাম শহরের দিকে আসা যাওয়া করে থাকে । এক হিসাব থেকে জানা যায় প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার শিক্ষার্থী শাটল ট্রেনে যাতায়াত করে। কিন্তু ট্রেনের বগির সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ার কারণে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীকে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য ট্রেনমুখী হতে হয়। প্রচণ্ড গরমে অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর চাপে চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ট্রেনের ভেতরে।
এর আগে দুটি ডেমু ট্রেন শিক্ষার্থীদের শহরমুখী যাত্রাকে সচল করতে সাহায্য করলেও প্রশাসন এসি ট্রেন দেবে বলে ডেমু ট্রেন তুলে নিল। কিন্তু এসি ট্রেন দিল কোথায়? প্রশাসন শিক্ষার্থীদের বগি বাড়াবে আশ্বাস দিলেও তা কার্যকর হলো কোথায়?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. শিরিন আখতার শাটল ট্রেনের বগি বৃদ্ধি নিয়ে রেলওয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করলেও কোনো কিছু হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ যেমন দোষারোপ দিচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে তেমনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দোষারোপ দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে। বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের থেকে পরিবহন খরচ বাবদ বাড়ালেও, শিক্ষার্থীদের দাবি কেউ মেটায়নি।
শাটল ট্রেনের সিট সংকুলান থাকা নিয়ে শিক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে ক্লাস করতে ক্যাম্পাসে আসে। অনেক শিক্ষার্থীকে অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে এমনকি হাসপাতালেও যেতে হয়। অনেকরে বাধ্য হয়ে ট্রেনের ছাদে উঠতে হয়, যা বয়ে আনে মারাত্মক দুর্ঘটনা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শুরুতে ১৭ জন শিক্ষার্থী ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যান। পড়ালেখা করতে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শাটল ট্রেন নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যাতায়াত খরচ বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়েছে ৪২ লাখ ৯২ হাজার টাকা। যা এক বছর পর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যাতায়াত খরচ নিয়েছে ৭৬ লাখ টাকা। চলতি বছরে তা ৮০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। দিনদিন প্রশাসনের যাতায়াত বাবদ আয় বাড়লেও, শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কমতি নেই বরং দিনদিন বাড়ছে।
নব নিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের আশার বাণী দেখাচ্ছে এই যন্ত্রণার ইতি ঘটার। আশা করি প্রশাসন অনতিবিলম্বে শিক্ষার্থীদের যন্ত্রণার কথা ভেবে শাটল ট্রেনের বগি বৃদ্ধি করবে, ট্রেনের ভেতরে পর্যাপ্ত ফ্যানের ব্যবস্থা করবে, ডেমু ট্রেনের মতো নতুন ট্রেনও বাড়াবে।
রাসেল হোসেন
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]