উন্মুক্ত পাঠাগার পড়ুক সারা দেশে

কবিগুরুর কথার সঙ্গে মিল রয়েছে নৈঃশব্দ্য মহাকালের; এখানে বয়সের কোনো বাছবিচার নেই, গরিব-ধনীর ব্যবধান নেই, নেই শ্রমিক-কর্মকর্তার ব্যবধান।ছবি : লেখক

বইপড়া প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়; তার কারণ, আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে একরকম মনের হাসপাতাল। তিনি লাইব্রেরিকে হাসপাতালের সঙ্গে তুলনা করেছেন, হাসপাতালে গেলে যেমন শরীরের অসুখ ভালো হয়, একইভাবে লাইব্রেরিতে এলে মনের অসুখ ভালো হয়। তার মানে লাইব্রেরি মনের অসুখ ভালো করার হাসপাতাল।

এই প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী আরও বলেছেন, ‘আমি লাইব্রেরিকে স্কুল–কলেজের ওপরে স্থান দিই এই কারণে যে এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়; প্রতি লোক তার স্বীয়শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। স্কুল–কলেজ বর্তমানে আমাদের যে অপকার করছে, সে অপকারের প্রতিকারের জন্য শুধু নগরে নগরে নয়, গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা কর্তব্য।’

সম্প্রতি তাঁর কথার বাস্তব রূপ দেওয়া হয়েছে ‘নৈঃশব্দ্য মহাকাল’ নামের উন্মুক্ত পাঠাগারটি স্থাপনের মাধ্যমে।

সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলায় নৈঃশব্দ্য মহাকাল নামের একটি উন্মুক্ত পাঠাগার গড়ে উঠেছে উপজেলা প্রশাসন রায়গঞ্জের পৃষ্ঠপোষকতায়। এই উন্মুক্ত পাঠাগারটি স্থাপন করে অনন্য নজির গড়ে সাধারণ পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান। সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কিছুদিন হলো পাঠাগারটির উদ্বোধন করেছেন। উদ্বোধনের আগে থেকেই উৎসুক পাঠক ভিড় করেন এই পাঠাগারে।

আজকাল বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, আমরা নিছক আড্ডায় সময় ব্যয় করি। যেখানে  প্রয়োজনীয় কাজের চেয়ে মূল্যহীন কাজই বেশি হয়। মূলত মাদকাসক্তি, বাল্যবিবাহ, মুঠোফোনে আসক্তি, বিভিন্ন রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বের করে বই পড়ার অভ্যাস এবং মননশীলতার চর্চা করতে সৃষ্টি হয়েছে নৈঃশব্দ মহাকাল নামের এই মহৎ উদ্যোগের।

শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে এসে বসেন, পড়েন তাঁদের পছন্দসই বইগুলো। গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, কাব্যগ্রন্থ, ধর্মীয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, শিশুসাহিত্যসহ দেশি-বিদেশি লেখকদের চার শতাধিক বই আছে এই পাঠাগারে।

বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, অবসর সময় কাটাতে চাওয়া কেউ অথবা কোনো শিশু স্কুল থেকে ফিরছে; বিকেলে খেলা শেষে এখানে এসে বসে তুলে নেয় পছন্দসই কোনো বই, বন্ধুদের সঙ্গে মেতে ওঠে বই নিয়ে আড্ডায়। বৃদ্ধরা পেনশন বা বয়স্ক ভাতার টাকা তুলতে এসেও অবসর সময়টুকু এখানেই কাটান, কোনো একটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করেন।

মোটকথা যিনি যখন সময় পান, এসে বসেন পাঠশালায়। রাত–দিন ২৪ ঘণ্টার যেকোনো সময় বসে বই পড়ার মতো নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এখানে। বই পড়ার পাশাপাশি পাঠকেরা একে অপরের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে গড়ছেন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত ‘লাইব্রেরী’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘লাইব্রেরীর মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার ওপর দাঁড়াইয়া আছি, কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়েছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়েছে, কোনো পথ মানব-হৃদয়ের অতল স্পর্শে নামিয়েছে। যে যেদিকে ইচ্ছা ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না।’

কবিগুরুর কথার সঙ্গে মিল রয়েছে নৈঃশব্দ্য মহাকালের; এখানে বয়সের কোনো বাছবিচার নেই, গরিব-ধনীর ব্যবধান নেই, নেই শ্রমিক-কর্মকর্তার ব্যবধান। যার যার ইচ্ছেমতো অবাধে ডুব দিতে পারছে জ্ঞানের মহাসাগরে, আরোহণ করতে পারছে জ্ঞান নামক মণি-মুক্তা। এমন মহৎ কর্মযজ্ঞ ছড়িয়ে পড়ুক বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে।

  • উজ্জ্বল কুমার মাহাতো
    লেখক ও পরিচালক, কুড়মালি পাঠশালা।
    [email protected]