শৈশব মানে আনন্দ, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার দিগন্ত। কিন্তু সেই শৈশব যখন ভেঙে যায় ইটভাটা, কারখানা কিংবা ক্ষতিকর পরিবেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের বোঝায়, তখন এটি একটি জাতির জন্য শুধু লজ্জা নয়, ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে শিশুশ্রম একটি গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সামাজিক অসচেতনতার চক্রে আটকা পড়া শিশুরা তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলে। জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি শিশুদের সুরক্ষা হলেও তাদের অধিকারের প্রতি এই চরম অবহেলা আজ বড় প্রশ্ন তোলে। বাংলাদেশে লাখ লাখ শিশু তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটাচ্ছে কঠিন শ্রমে। গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে নির্মাণশিল্প, ইটভাটা, কৃষি কিংবা কারখানায় শিশুশ্রমিকের উপস্থিতি ক্রমে বেড়েই চলেছে। অভিভাবকদের দারিদ্র্য, শিক্ষার সুযোগের অভাব এবং অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শিশুদের শ্রমে ঠেলে দেয়।
শিশুশ্রম কেবল একটি শিশু বা তার পরিবারের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনে। শিশুশ্রমের ফলে শিশুরা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হয়। কঠোর পরিশ্রম তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে, শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেয় এবং তাদের জীবনের সম্ভাবনাগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। যেসব শিশুশ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত, তারা প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগে। শিশুশ্রমের সামাজিক প্রভাবও গভীর। এটি দারিদ্র্যের চক্রকে আরও পোক্ত করে। কারণ, শিশুশ্রম পরিবারগুলোর অবস্থা উন্নত করার পরিবর্তে তাদের শিক্ষার সুযোগ নষ্ট করে, যা ভবিষ্যতে উন্নতির পথ রুদ্ধ করে। তদুপরি, শিশুরা যখন ছোটবেলায় শ্রমে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা সহজেই অপরাধমূলক কার্যকলাপ বা শোষণের শিকার হতে পারে।
শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য। একটি দরিদ্র পরিবারে শিশুরা প্রায়ই বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। অভিভাবকেরা তাদের স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে কাজে পাঠিয়ে দেন। এ ছাড়া অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাব বড় ভূমিকা পালন করে। অনেক অভিভাবকই জানেন না যে শিশুশ্রম তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য কতটা ক্ষতিকর। বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের পরিমাণ বেশি, যা শিশুশ্রমকে আরও বাড়িয়ে তোলে। অনেক ছোট কারখানা ও গৃহস্থালির কাজে শিশুদের নিযুক্ত করা হয়। কারণ, তারা সস্তা শ্রমশক্তি। সামাজিক প্রথা ও মানসিকতার কারণেও শিশুশ্রম টিকে থাকে, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় যেখানে শিশুদের কাজ করাকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হয়।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম বন্ধে বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে শিশুদের কাজ করা নিষিদ্ধ। তবে এসব আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আইন বাস্তবায়নে দুর্বলতা, পর্যাপ্ত তদারকির অভাব এবং সামাজিক সচেতনতার ঘাটতি আইনগুলোর কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করছে। অনেক সময় শিশুশ্রমের শিকার পরিবারগুলোও সরকারের সহায়তা প্রকল্পের বাইরে থাকে। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য তৈরি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো সব সময় তাদের কাছে পৌঁছায় না। তা ছাড়া দ্রুত নগরায়ণ এবং গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন শিশুশ্রমে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
শিশুশ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজের প্রতিটি অংশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পরিবার, স্কুল, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। শিশুশ্রমমুক্ত একটি সমাজ গড়ার অর্থ হলো একটি জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা। শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ, নিরাপদ শৈশব ও স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা যদি সবাই মিলে কাজ করি, তাহলে একদিন শিশুশ্রম একটি অতীতের অধ্যায় হয়ে উঠবে। সেই দিনের প্রত্যাশায় আমাদের আজকের উদ্যোগগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
হৃদয় পান্ডে
শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ