নির্বিচারে সাপ মেরে উল্টো নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছি

সাপের কামড়ে অধিকাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মূলত যথাসময়ে চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে।ফাইল ছবি

সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া নামের এক প্রজাতির বিষধর সাপ, যা জনমানুষের মনে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। যে আতঙ্কের কারণে চরাঞ্চলের মানুষেরা যেতে পারছেন না তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্মে। বিশেষ করে কৃষিজমিতে এই সাপের উৎপাত বাড়ায় কৃষকদের হতাহতের ঘটনা বাড়ছে। বাসাবাড়িতেও এর উৎপাত অনেক বেশি, যার কারণে রাসেলস ভাইপার নিয়ে মানুষের উৎকণ্ঠার শেষ নেই। ফলে সাপ-আতঙ্ক থেকে বর্তমানে নির্বিচারে চলছে সাপ নিধন, যা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের মতে, ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত মোট ৩২টি জেলায় রাসেলস ভাইপার দেখা গেছে। বিষয়টি নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি, উদ্বেগ ও আতঙ্ক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব, সংবাদমাধ্যমে অতিরঞ্জিত ও খণ্ডিত সংবাদের কারণে বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে রাসেলস ভাইপার সন্দেহে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ মেরে ফেলা হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, সব সাপই কি আতঙ্কের? বা সব সাপই কি মানুষের জন্য ক্ষতিকর? অথবা সব সাপই কি বিষধর? এক বাক্যে উত্তর আসবে ‘না’। বাংলাদেশে যত প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই বিষহীন। মাত্র সাত থেকে আট প্রজাতির সাপ বিষধর। তা ছাড়া এসব বিষধর সাপের এক ছোবলেই যে মানুষের মৃত্যু হয়, বিষয়টি এমন নয়। সাপের কামড়ে অধিকাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মূলত যথাসময়ে চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২৩ সালে সাপের কামড়ে সাড়ে সাত হাজার মানুষ মারা গেছেন। যাঁদের বেশির ভাগই কোবরা ও কেউটে প্রজাতি সাপের কামড়ের শিকার হয়েছেন। সুতরাং রাসেলস ভাইপার নিয়ে জনমনে আতঙ্কের যে ডালপালা ছড়িয়েছে, তা অযৌক্তিক।

সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ভেনম রিসার্চ সেন্টার গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পুরোনো ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং যেখানে এই সাপ থাকার কোনো আশঙ্কা নেই, সেই জায়গার ছবিতে সাপ দেখিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে রাসেলস ভাইপার সন্দেহে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ মেরে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মানুষজন না বুঝেই নির্বিচারে একের পর এক সাপ হত্যা করছেন। সাপ প্রকৃতপক্ষে মানুষ শিকার করে না এবং সাপকে কোনো কারণে উত্তেজিত করা না হলে বা সাপ আঘাতপ্রাপ্ত না হলে তারা মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। ব্যতিক্রম ছাড়া কনস্ট্রিক্টর ও বিষহীন সাপগুলো মানুষের জন্য কোনো হুমকি নয়। তাহলে দেশের পুরো সাপ প্রজাতির ওপর এই বিধ্বংসী আক্রমণ কেন? এটি জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না তো!

বলা বাহুল্য, একটি সুস্থ সবল বাস্তুতন্ত্রে খাদ্যশৃঙ্খলে ছোট্ট একটি পরিবর্তনও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিশাল হুমকি, যা ক্রমান্বয়ে বিপদ ডেকে আনবে। এটি জনস্বাস্থ্যেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে গেলে কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনি বাসাবাড়িতে এর উপদ্রবে মানুষেরও ভোগান্তি বাড়বে।

বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্যমতে, কিছুদিন ধরে দেশে রাসেলস ভাইপার সন্দেহে হত্যার শিকার প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি সাপই নির্বিষ। অথচ বিষহীন সাপ মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং এসব প্রকৃতির বন্ধু। প্রকৃতপক্ষে সাপ পরিবেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাণী। খাদ্যশৃঙ্খলে সাপের রয়েছে বিশেষ অবদান। সাপের বিষ থেকে বিভিন্ন রকমের ওষুধ তৈরি করা হয়। তা ছাড়া সাপ কৃষকের অনেক উপকার সাধন করে। যেমন সাপ নানা রকম পোকামাকড়, ব্যাঙ, ইঁদুর খেয়ে বেঁচে থাকে, যেগুলো ফসলের জন্য অনেক ক্ষতিকর। আবার এই সাপকে শকুন, প্যাঁচা, বেজিজাতীয় কিছু প্রাণী খেয়ে থাকে। এসব প্রাণীও পরিবেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থাৎ একদিকে সাপ যেমন নিজের খাদ্য হিসেবে মানুষের জন্য ক্ষতিকর প্রাণীকে খেয়ে উপকার করছে, অন্যদিকে তেমনি পরিবেশের অন্যান্য উপকারী প্রাণীর খাদ্য হিসেবেও কাজে লাগছে। কিন্তু মানুষ যেভাবে প্রতিনিয়ত সাপ নিধন করছে, তাতে সাপের সংখ্যা যদি অত্যধিক কমে যায়, তাহলে স্বাভাবিক খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হবে। যেমন ইঁদুর, পোকামাকড়, ব্যাঙ এগুলোর সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে যাবে। আবার খাদ্যাভাবে শকুন, প্যাঁচা এগুলোর সংখ্যা বেড়ে যাবে। কোনো প্রজাতির এরূপ পরিবর্তনই পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

বলা বাহুল্য, একটি সুস্থ সবল বাস্তুতন্ত্রে খাদ্যশৃঙ্খলে ছোট্ট একটি পরিবর্তনও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিশাল হুমকি, যা ক্রমান্বয়ে বিপদ ডেকে আনবে। এটি জনস্বাস্থ্যেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে গেলে কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনি বাসাবাড়িতে এর উপদ্রবে মানুষেরও ভোগান্তি বাড়বে। প্রকৃতিতে সবকিছুরই ভারসাম্য প্রয়োজন। নয়তো প্রকৃতি তার ভয়াবহ রূপ দেখাতে বাধ্য হয়। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে, পরিবেশে ভারসাম্য বজায় রাখতে সর্বোপরি মানুষের স্বার্থেই নির্বিচারে সাপ মারা বন্ধ করতে হবে।

জান্নাতুল ফেরদাউস

শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)