সুখী দেশের তালিকা প্রকাশিত হলেই সমাজের নানা স্তরে আলোচনা শুরু হয়, কেন আমাদের অবস্থা এমন? আমার মনে হয়, প্রধান কারণ হলো কিসে, কীভাবে, কী করলে, কী পেলে সুখে থাকব—এই ধারণায় আমাদের অস্পষ্টতা আছে এবং আমরা অস্পষ্টতা রেখেই এগোতে থাকি আন্দাজে, যখন যা মনে আসে।
আমাদের মধ্যে একটা চরম ঝোঁক দেখা যায়, অন্যদের দেখে সুখী হওয়ার জন্য লক্ষ্য স্থির করায়। অন্য কেউ একজনের একটা কিছু হচ্ছে, আমার সেটা হচ্ছে না বা নেই কেন, এটাকে আমরা অসুখ ধরি আর সেটা পাওয়াকে সুখ মনে করি। এই সুখের মুখোশপরা লোলুপতা অসীম চক্রাকারে এবং গুণোত্তর ধারায় চারপাশের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
সুখ নামের ফাঁপা বিভিন্ন লক্ষ্যের দিকে এই উন্মত্ত ছোটার কারণে সম্পদ ও সুযোগের অপচয় ও অপব্যবহার হতে থাকে। ফলে এই চক্র থেকে বের হওয়ার রাস্তা আরও সংকীর্ণ হয়, চক্র আরও শক্তিশালী হয়।
এই অপচয় ও অপব্যবহার যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে, তেমনি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের দ্বারাও হচ্ছে। আমি মনে করি, রাষ্ট্রীয় যে অপব্যবহার, এটা আমাদের ব্যক্তিগত অপব্যবহারের অভ্যাস ও মানসিকতারই পরিবর্ধিত ফলাফল।
এই অপব্যবহার দিন শেষে সামনে নিয়ে আসে মৌলিক চাহিদাগুলোর ব্যাপারে চরম অনিশ্চয়তা। আর তখনই আমরা বুঝতে পারি, কতটা অসুস্থ হয়ে গেছে আমাদের সবকিছু।
এখানে এই পর্যায়ক্রম বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। এই যে শেষ স্তরে এসে যখন আমাদের অসুখ আমরা ধরতে পারি, তখন একলাফে রাষ্ট্রের দুর্নীতি, বৈশ্বিক অর্থনীতি, ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য ইত্যাদি বড় পরিসরের বিভিন্ন বিষয়কে এর কারণ হিসেবে ধরে নিই। এ রকম বড় বিষয়গুলোকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে আমরা একদিক থেকে দায়মুক্ত থাকতে চাই যে এগুলো এমন পর্যায়ের ব্যাপার, যা আমার হাতে নেই; অর্থাৎ আমার অসুখের জন্য আমি একেবারেই দায়ী নই!
কিন্তু ওপর থেকে নিচের শেষ ফলাফল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমটা চিন্তা করলে বোঝা যায়, অসুখের কারণ অনেক সূক্ষ্ম, অনেক সাধারণ। নিত্য মুহূর্তের ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্ত ও অবস্থানের সঙ্গে এর সরাসরি সংযোগ।
এখন এটা বুঝে সেই অবস্থা পরিবর্তন করেই পরিপূর্ণ সুখ আশা করা যাবে না। কারণ, ইতিমধ্যে সবার এই একই রকম অবস্থানের কারণে বিশাল একটা চক্র তৈরি হয়েছে আর সেই চক্র থেকে বের হওয়ার রাস্তাও জটিলতর হয়েছে।
আমার মনে হয়, সুখী দেশের তালিকায় যারা ওপরের দিকে আছে, তাদের ওই প্রথম ধাপে অবস্থান বেশি স্পষ্ট আমাদের চেয়ে। তারা একটা ভাবনা এলে, একটা অবস্থান নিতে হলে ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার দেখে, বারবার চিন্তা করে—আসলেই কি এটাই আমি চাই? এভাবে ভাবার পরও যখন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি আসে, তারা আবার ভাবনাটি যাচাই করতে বসে—এটাই কি আমার জন্য সেরা অবস্থান, সেরা সিদ্ধান্ত, সেরা দৃষ্টিভঙ্গি?
শুধু এখনকার জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্যও? আসলে কী দরকার আর কী দরকার নেই, এটা তারা নিজেকে জিজ্ঞেস করে বেশি। অন্যকে দেখে ভাবে বা সিদ্ধান্ত নেয় কম।
মঈনুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, সম্মান (তৃতীয় বর্ষ)
ব্যবস্থাপনা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
ই-মেইল: [email protected]