ভয়কে কর জয়, জাগো গো ভগিনী

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

আজ থেকে ১৪২ বছর আগে ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক মহীয়সী নারী, যার নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর সময়ে নারীদের কোনো রকম শিক্ষা গ্রহণ করা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষা ছিল না। চার দেয়ালে বন্দি জীবন কাটাতে হতো নারীদের। জাতি গঠনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন বেগম রোকেয়া। তিনি না হলে নারী শিক্ষার পথ অগ্রসর করা সম্ভব হতো না। নারীকে অন্ধকারের বন্দি সমাজ থেকে মুক্ত করেন বেগম রোকেয়া। তাই তো বেগম রোকেয়াকে বলা হয় বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত।

আজ তিনি স্ব-শরীরে আমাদের মাঝে বেঁচে নেই এটি মহা সত্য কথা কিন্তু তাঁর সংগ্রামী জীবনের মাধ্যমে সমাজের প্রত্যেক মানুষের অন্তরে আলোর প্রদীপ হিসেবে থাকবেন চিরকাল। এই আলোর প্রদীপ যেন জ্বলতে থাকবে প্রতিটি ভগিনীর হৃদয়ে। তবে দুঃখের বিষয় বর্তমানে কুরুচিপূর্ণ বেহায়াপনা অপসংস্কৃতি ও কূপমণ্ডূক শিক্ষার ধ্যান- ধারণা দিয়ে এখনও নারীর অধিকার খর্ব করতে প্রস্তুত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।

বেগম রোকেয়া শোষণমূলক ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের সচেতন করতে লেখনীর ধারা অব্যহত রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমতঃ যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’ তিনি সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেনছেন। বর্তমানে পুঁজিবাদী সমাজে অনেক কিছুই পরিবর্তন হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে নিয়ে ভোগপণ্য মানষিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রতিনিয়ত ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সকল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের মাধ্যমে নারীদের অপমান  করা হয়। নারী পুরুষের তুলনায় অতি নগণ্য এই ধারণা সমাজের প্রত্যেক পুরুষের মাথায় গিজগিজ করে বুঝানো হয়। এমনকি নতুন প্রজন্মের কন্যা শিশুদের এমন ধারণা দিয়ে বড় করে গড়ে তোলা হয়। তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে আমরা একটি সুস্থ সমাজে বাস করছি কি?

বেগম রোকেয়া আমাদের একটি সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। যিনি ছিলেন সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসংস্কারক এবং নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। বেগম রোকেয়ার পূর্বপুরুষগণ মুগল আমলে উচ্চ সামরিক এবং বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োজিত ছিলেন।

বেগম রোকেয়ার পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল। বেগম রোকেয়ার বড়ো দুই ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তাঁরা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করেন। ফলে ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটে এবং তা তাঁদের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করে। তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হন বেগম রোকেয়া।

বেগম রোকেয়ার সমগ্র সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কূফল, নারীশিক্ষার পক্ষে তাঁর নিজস্ব মতামত, নারীদের প্রতি সামাজিক অবমাননা এবং নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে তাঁর প্রাগ্রসর ধ্যানধারণা। বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও তাঁর লেখনী ছিল সোচ্চার। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর দুরবস্থা এবং দৈহিক-মানসিক জড়ত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় যে শিক্ষা এ ধারণাই রোকেয়া তুলে ধরেন তীক্ষ্ণ ভাষায় ও তীর্যক ভঙ্গিতে। এক প্রতিকূল সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের খন্ড খন্ড চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর রচনায়। সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনের দুর্দশার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তাঁর বহু প্রবন্ধ ও নকশাজাতীয় রচনায়।

ছোটোগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও শ্লে­ষাত্মক রচনায় বেগম রোকেয়ার লেখনী ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা তাঁর রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তাঁর প্রবন্ধের বিষয় ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিজ্ঞান সম্পর্কেও তাঁর অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন রচনায়।

লোকচক্ষুর অন্তরালে এই সমিতি মুসলমান নারীদের কল্যাণে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করেছে। সমিতিতে যোগদানের জন্য রোকেয়া নানা অপবাদ মাথা পেতে নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে নারীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। এই সমিতি ভারতবর্ষের শাসন-সংস্কারে নারীর রাজনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে মতামত তুলে ধরে। নারীদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য এই সমিতি শিল্প প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করে। নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেগম রোকেয়ার নেতৃত্বে আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম সে যুগে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে যেসব নারী নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই বেগম রোকেয়ার স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করে তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হন।

নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং আলোর দিশারী বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় বায়ান্ন বছরে মৃত্যুবরণ করেন। ১৪২তম জন্মবার্ষিকী ও ৯০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে লাল সালাম! সময় এসেছে তাঁর সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে ভয়কে কর জয়, জাগো গো ভগিনী। কারণ তিনি যেমন সকল সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে নারী শিক্ষা এগিয়ে নিয়েছেন। ঠিক তাঁর মত করে আজকে নারীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। ঘরে বাইরে নারী নির্যাতন বন্ধে একমত হয়ে লড়াই করতে হবে। নারীর স্বাধীনতা যারা খর্ব করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে যুক্তিসহ জবাব দিতে হবে।

রাষ্ট্রের উচিত বিচারহীনতার সংস্কৃতি পরিবর্তন করে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংতার  ঘটনায় হাত কিংবা পা ধরে গ্রাম্য শালিসির মাধ্যমে যেন সমাধানের পথ না নেওয়া হয় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে সম অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে মানুষ ভাবার শিক্ষা এবং নারীর অধিকার সর্বপ্রথম পারিবারিক পরিমণ্ডলেই নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি নির্যাতন সহিংসতা বন্ধের জন্য পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হলে নাটক, সিনেমা, পথসভার মাধ্যমে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
সাংবাদিক