সম্প্রতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চালানো এক গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর মাথায় জীবনের কোনো না কোনো সময় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে। উচ্চশিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রায় ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী চরম দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা যেখানে দেশের ভবিষ্যৎ, সেখানে তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশের চিন্তাধারা আমাদের জন্য অশনিসংকেত বলা যায়। আত্মহত্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে। যেসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা বেড়েছে:
আবেগপ্রবণ: আবেগপ্রবণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এ সমস্যা বিশেষ করে নবীন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, অর্থাৎ চলাফেরা, বন্ধু নির্বাচন, খাবারদাবার বা ক্যাম্পাসজীবনের শুরুর দিকে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হলে সেসব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে কেউ কেউ আবেগবশত আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এ জন্য নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রবীণ শিক্ষার্থীদের বন্ধুসুলভ আচরণ করা প্রয়োজন, যা এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
পরিবার থেকে দূরে: কখনো কখনো শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত, সে কারণে শিক্ষার্থীদের পরিবার ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতে হয়। এতে করে স্বাভাবিকভাবে পরিবারের সঙ্গে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে ছেলে-মেয়েদের অবাধ চলাফেরার সুযোগ তৈরি হয়। মন খারাপের সময় পরিবারের তেমন পৃষ্ঠপোষকতা পান না। এতে করে কেউ কেউ এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
র্যাগিং: স্কুল, কলেজ শেষ করে একজন শিক্ষার্থী সুনীল স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখেন। তাঁদের পূর্ব শিক্ষাজীবনে র্যাগিং নামের নির্মমতার সঙ্গে পরিচিত ছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এমন এক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যে কারণে তাঁরা মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। প্রথমত, পরিবার থেকে দূরে। আর দ্বিতীয়ত নতুন পরিবেশ। এর মধ্যে র্যাগিংয়ের নাম করে মানসিক চাপের কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা আত্মহত্যা করার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তাই নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগিংয়ের নামে মানসিক চাপ দেওয়া উচিত নয়।
রাজনৈতিক চাপ: গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে নানামুখী চাপের সম্মুখীন হন। এর মধ্যে অন্যতম একটি চাপ, রাজনৈতিক চাপ। শিক্ষার্থীদের হলে ওঠার সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে অন্য বিষয়গুলোর প্রতি কর্তৃপক্ষের পরিপূর্ণ নজরদারি থাকে না। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের চাপের মুখে পরতে হয়। এতে করে শিক্ষার্থীদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তাঁরা সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকেন। তাঁরা মনোবল হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। যে কারণে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
ভালো বন্ধুর অভাব: বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুর দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভালো বন্ধু নির্বাচন করা। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুর দিকে একজন শিক্ষার্থী যেমন বন্ধু নির্বাচন করবেন, সেটা ভবিষ্যৎ-জীবনে তাঁকে সেভাবে প্রভাবিত করবে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুর দিকে তাড়াহুড়ো করে বন্ধু নির্বাচন করতে গিয়ে ভুল মানুষকে নির্বাচন করে ফেলেন। আর সেই সব সম্পর্কের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বিপথে পা বাড়ান। খারাপ মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বিপথগামী হওয়ার পর নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তখন হীনম্মন্যতায় ভোগে। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
মাদকদ্রব্য সেবন: বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদকের ব্যবহার বেড়েছে। এখানে নবীন থেকে প্রবীণ, শত শত শিক্ষার্থী মাদকে আসক্ত। মূলত প্রবীণ শিক্ষার্থীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নবীন শিক্ষার্থীরা এই মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ করেন। সেসব শিক্ষার্থী বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে থাকেন। অনেক সময় অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের কারণে তাঁরা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এমন অবস্থায় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
প্রেমে ব্যর্থতা: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেসব কারণে আত্মহত্যা করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, প্রেমে ব্যর্থতা বা মনোমালিন্য।
অর্থনৈতিক চাপ: বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। সেই কারণে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু থেকেই আর্থিক চাপের মুখে পড়তে হয়। পরিবার থেকে আসতে থাকে নিজের খরচ জোগানোর তাগিদ। এমন সময় শিক্ষার্থীরা পরিবারের কাছে খরচের টাকা চাইতে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। যে কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
সামাজিক চাপ: বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুর দিকে সামাজিক কোনো চাপ না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষের দিকে হাজারো সামাজিক চাপের বোঝা লক্ষ করা যায়। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট—সব জায়গায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। এমনকি অনেকে সামনেও আজেবাজে মন্তব্য করে থাকেন। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা এলাকায় যেতেও হীনম্মন্যতায় ভোগেন। এসব ঘটনা গ্রামে-গঞ্জে বেশি লক্ষ করা যায়। যে কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এমন অবস্থায় কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
মিজানুর রহমান মিজান
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ