সুন্দরবন বাংলাদেশের একটি অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। পর্যটকেরা কটকা, করমজল, দুবলারচর ও হিরণ পয়েন্টের মতো জায়গাগুলোতে যেতে পারেন, যেখানে প্রকৃতি তার নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে অপেক্ষা করে। দুবলারচরের রাসমেলা শীতকালের আরেকটি প্রধান আকর্ষণ।
সুন্দরবনের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দুবলারচর একটি মনোরম ও আকর্ষণীয় স্থান, যা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এটি খুলনা জেলার অংশ এবং বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে সুন্দরবনের গহিনে অবস্থিত। দুবলাচরের অন্যতম আকর্ষণ হলো এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শীতকালে অনুষ্ঠিত রাসমেলা।
দুবলারচর মূলত জেলেদের অস্থায়ী নিবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে মাছ শিকার এবং শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ চলে। শীতকালে এখানে বিভিন্ন স্থান থেকে জেলে এবং পর্যটকেরা সমবেত হন। রাসমেলা, যা ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পরিচিত, প্রতিবছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমার রাতে অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলায় হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রস্নান করতে আসে এবং বিভিন্ন পূজা-অর্চনার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া দুবলারচরের সমুদ্রসৈকত এবং অসংখ্য পাখির আনাগোনা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য বাড়তি আনন্দের কারণ।
দুবলারচর তার শান্ত পরিবেশ, অপার সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যবাহী রাসমেলার কারণে সুন্দরবন ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। এখানে এসে মানুষ প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়া পায় এবং ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি ভুলে যেতে পারে।
সুন্দরবনের দুবলারচরের জেলেদের জীবন এক অনন্য সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা এই চর মূলত শুঁটকি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত, আর এর পেছনে কঠোর পরিশ্রম করেন এখানকার জেলেরা। তাঁদের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে। ঝড়, জোয়ার-ভাটা এবং বন্য প্রাণীর হুমকির মধ্যে তাঁদের জীবনযাপন প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
তারা সাগরে মাছ ধরার কাজ করেন এবং সেই মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করেন। দিনের পর দিন খোলা আকাশের নিচে এবং ঝুপড়ি ঘরে তাঁদের রাত কাটে। আধুনিক সুবিধাবঞ্চিত এই এলাকায় বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাব প্রকট। জেলেদের কষ্টকর জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়ে যখন তাঁরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন ঘূর্ণিঝড় বা প্রবল জোয়ারের মুখোমুখি হন।
দুবলারচরের জেলেরা একটি অস্থায়ী এবং কঠিন জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে দিন পার করেন। প্রতিবছর শীত মৌসুমে, অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত, তারা সমুদ্র থেকে মাছ শিকার করেন এবং সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে শুঁটকিতে রূপান্তর করেন। তবে এই পাঁচ মাসের সময়ে তাঁদের বাসস্থান এবং জীবনযাপন অত্যন্ত কষ্টকর। উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি থাকায় তাঁরা চটের তৈরি সামান্য ঘরে বাস করেন, যা যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।
শীতকাল জেলেদের জন্য চরম কষ্টের সময়। সামান্য চটের ঘর তাঁদের ঠান্ডা থেকে কোনো সুরক্ষা দিতে পারে না। শীতের রাতে মাটির মেঝেতে পাতলা বিছানা বিছিয়ে ঘুমানো তাদের জন্য দুঃসহ হয়ে ওঠে। এ ছাড়া প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়াটাও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য। ঠান্ডা বাতাস, শিশিরভেজা শরীর এবং উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়েও তাঁরা জীবিকার তাগিদে দিনরাত পরিশ্রম করেন।
এই জেলেরা দিনরাতের কঠোর পরিশ্রমে মাছ সংগ্রহ করে এবং তা প্রক্রিয়াজাত করে শুঁটকি তৈরি করেন, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু তাঁদের জীবনযাত্রার এই কঠোর বাস্তবতা এবং শীতের কষ্ট প্রায়ই অদেখা থেকে যায়। তাঁদের জন্য যথাযথ আবাসনব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শীতের মোকাবিলায় সহায়তা প্রদান করা অত্যন্ত প্রয়োজন, যাতে তাঁরা নিরাপদ ও স্বস্তির মধ্যে কাজ চালিয়ে যেতে পারে।
জেলেদের এই কঠোর পরিশ্রমের ফলেই দুবলারচরের শুঁটকি দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে সমাদৃত হয়। তবে তাঁদের জীবনযাপন অত্যন্ত কষ্টকর ও অনিশ্চিত। ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, দালালদের শোষণ এবং নিরাপত্তাহীনতা তাঁদের জীবনকে আরও সংকটপূর্ণ করে তোলে। এরপরও পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর আশায় তাঁরা এই কঠিন পেশাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকেন। দুবলারচরের জেলেদের সংগ্রাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরিশ্রমের শক্তি এবং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের অনিবার্য বাস্তবতা।
দুবলারচর, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হলেও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এখানকার বাসিন্দারা চরম ভোগান্তির শিকার। দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানে টেলিযোগাযোগ–ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। বিশেষ করে দুবলারচরে শুধু টেলিটক সিমের নেটওয়ার্ক কিছুটা পাওয়া যায়, তবে অন্যান্য মোবাইল অপারেটরগুলোর নেটওয়ার্ক একেবারেই অনুপস্থিত। এ কারণে স্থানীয় জেলে এবং অস্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য যোগাযোগ রক্ষা করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে।
মাছ ধরতে গিয়ে জেলেদের অনেক সময় গভীর সমুদ্রে আটকে পড়তে হয় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়লে সাহায্যের জন্য যোগাযোগের কোনো উপায় থাকে না। নেটওয়ার্কের অভাবে জরুরি প্রয়োজনে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা তো দূরের কথা, বিপদে পড়ে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকি বা দুর্ঘটনার মতো পরিস্থিতিতে দ্রুত সেবা পাওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুঁটকি মাছের ক্রেতা-বিক্রেতাদের যোগাযোগেও বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।
সরকারি উদ্যোগের অভাব এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন না থাকায় এই অঞ্চলের মানুষ এখনো যোগাযোগ–বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। সুন্দরবনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নেটওয়ার্ক–ব্যবস্থা উন্নত করা জরুরি, যাতে স্থানীয় বাসিন্দারা আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা পেতে পারে এবং তাঁদের জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও সহজ হয়।
হালিমা আক্তার হানি শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ