বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের ভাগ্য ৩২ বছরেও বদল হলো না

একজন শিক্ষক আগে মানুষ পরে শিক্ষক। তাই সবার আগে সামাজিক জীব হিসেবে মৌলিক চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসতে হয়।ফাইল ছবি

১৯৯৩ সালে কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে আজ অবধি ২ হাজার ২৫৭টি প্রতিষ্ঠান অধিভুক্তির মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। দীর্ঘ ৩২ বছর যাবৎ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা যতবার শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এমপিওর দাবি আদায়ের চেষ্টা করছেন, ততবারই সরকার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে।

শিক্ষা কখনো বিক্রি হয় না বা হওয়ার নয়; তবে শিক্ষকের জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের ঘাটতি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রতীয়মান হলে সেখানে নীতিকথা আর টেকে না। লোভ-লালসাকে বিসর্জন দিয়েই শিক্ষকতায় আসতে হয়, তাই সবাই শিক্ষকতায় আসতে পারেন না। একজন শিক্ষক আগে মানুষ পরে শিক্ষক। তাই সবার আগে সামাজিক জীব হিসেবে মৌলিক চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসতে হয়।

এ জন্য পেশার বিনিময়ে তিনি ন্যূনতম আর্থিক প্রাপ্তি কামনা করেন। আক্ষেপের বিষয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রায় সব কলেজ ও প্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষকদের ন্যূনতম আর্থিক মজুরি প্রদান করে না; পিএফ, অবসর ও কল্যাণ ভাতার কথা বাদই দিলাম।

সব ধরনের বৈষম্যের একমাত্র সমাধান অনার্স ও মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও প্রদান, যার মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সব কলেজের শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আসতে পারে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সরকার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যে কেউ চাইলেই এমপিওর ব্যবস্থা করতে পারে, শুধু প্রয়োজন নীতিগত সিদ্ধান্ত।

বেসরকারি কলেজগুলোয় উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শিক্ষকের পাশাপাশি মাত্র দু-তিনজন শিক্ষক কর্মরত। বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়, প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষক বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করছেন। সে ক্ষেত্রে বর্তমান বেতন স্কেল হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি মাসে মাত্র ২০০ কোটি টাকার জোগান হলে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকের এমপিও প্রদান করা শুধু সময়ের ব্যাপার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ২৮ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা; শিক্ষা খাতের মোট বরাদ্দের কথা বাদই দিলাম। অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকের এমপিওর জন্য প্রয়োজন মাত্র ২০০ কোটি টাকা, যা উন্নয়ন বাজেটের শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, অর্থাৎ ১ শতাংশের চেয়ে কম। এ থেকে বোঝা যায়, অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকের এমপিওর বাধা শুধু নীতিগত সিদ্ধান্ত। আরও মজার বিষয় হলো, ব্যবহার করতে না পারায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত পাঠায়।

সমন্বিত আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে দুটি ডিও লেটার সংগ্রহ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কর্তৃক দুটি সুপারিশ আদায়, ডিজি মহোদয়ের সুপারিশ প্রাপ্তিসহ হাইকোর্ট বিভাগের চূড়ান্ত রায় পাওয়ার পর অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০১৮ সালে এমপিও নীতিমালা সংশোধন কমিটিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের জনবলকাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে।

সর্বশেষ ২০২৩ সালে বর্তমান ভিসি ও শিক্ষামন্ত্রী আশা দেখালেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপত্তি থাকার কারণে ৩২ বছর ধরে অবহেলিত শিক্ষকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর দায়ভার এড়াতে পারে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় প্রায় ১ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, অথচ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকের এমপিওর জন্য লাগে মাত্র ২০০ কোটি টাকা।

অর্থাৎ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিজেও এমপিও প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারে, যার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিকল্প ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর আয়-ব্যয় না করেও এমপিও প্রদান করতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি কলেজগুলোয় প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষার্থী আছেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বেতন থেকে বার্ষিক ৭১৫ টাকা অর্থাৎ মাসে ৬০ টাকার মতো সংগ্রহ করা গেলে এমপিও প্রদান করা সম্ভব।

মো. শাহাদাত হোসেন, শিক্ষক