ছোটবেলায় বাবাকে ডায়েরি লিখতে দেখতাম। এখন নিজেও চেষ্টা করি। নানা ধরনের কথা আছে সেই ডায়েরিতে। লিখি নিজের কথা। নিজের অনুভূতির কথা। একসময় জানতে পারলাম এটাও একধরনের যোগাযোগ। যোগাযোগ বিদ্যায় যার নাম অন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ। উপমহাদেশে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত বলেছিলেন, ‘নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি রপ্ত করতে পারলেই সৃজনশীল মানুষ হওয়া সম্ভব। সব কথা সবার জন্য উন্মুক্ত করতে নেই।’
প্রত্যেকের জীবনেই নিজস্ব কিছু বিষয় থাকে, যা একান্তই নিজের, আবার কিছু বিষয় সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে ফেসবুকীয় প্রদর্শনবাদিতা এত ব্যাপকতা পেয়েছে যে আমাদের স্বাধীনতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। অনেকেই ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্ট্যাটাস পোস্ট করেন, আবার ঘুম থেকে উঠে নতুন স্ট্যাটাস দেন। হরহামেশাই নিজের অবস্থান, মন খারাপের মুহূর্ত, ভালো লাগার মুহূর্ত ইত্যাদি সম্পর্কে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন। কিন্তু কখনো কি খেয়াল করেছেন, এতে আপনার গোপনীয়তা বা ব্যক্তিত্বে রহস্য বলে আর কিছুই থাকছে না।
আমার এই মুঠোয় বন্দী ছোট্ট স্ক্রিনে চোখ রেখে একমুহূর্তেই বলে দিতে পারি, আপনার পছন্দের মানুষ থেকে শুরু করে আপনার বেডশিটের রং পর্যন্ত। বাছাইকৃত ব্যক্তিরাই আপনার বন্ধু তালিকায় স্থান পায়। তাঁদের মধ্যে থাকে আপনার পরিবারের সদস্য, স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সুপরিচিত মানুষজন অথবা এলাকার শ্রদ্ধেয় ছোট-বড় ভাই। আবার তাঁদেরই কেউ হতে পারে অন্যের চোখে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, নারী নিপীড়নকারী বা প্রতারক। তাই আপনার বন্ধুতালিকায় যুক্ত থাকা ব্যক্তিরা আপনার জন্য কতটা নিরাপদ, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়।
কোথাও ঘুরতে গেলে জায়গাটির সৌন্দর্য অবলোকনের চেয়েও মুখ্য হয়ে ওঠে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলা। ছবিগুলো আপলোড করেই লাইক, শেয়ারের বন্যায় ভেসে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। জীবন ক্ষণস্থায়ী সবাই জানি, কিন্তু কথাটি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি কজন? মৃত্যু আমাদের কাছে অনেক দূরের বিষয় মনে হয়, কিংবা আমার জন্য নয়, এমনটিই মনে হয়। বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর, মহাকালের হিসেবে, যা একটি মুহূর্ত মাত্র। তাহলে একবার ভাবুন তো, ক্ষণস্থায়ী জীবনে এই লাইক, শেয়ারের আনন্দটা কতটুকু ঠুনকো? মৃত্যুর পর তো দূরের কথা, দুই দিন পরেই বা কজন মনে রাখবে আপনার এই ভাইরাল পোস্ট? এই লাইক শেয়ারের গোলকধাঁধাময় জীবনাচরণে চাঞ্চল্য থাকলেও নেই প্রাণের ছোঁয়া। আমরা যদি শুধু লাইক শেয়ারের আশায় পোস্ট করি তবে ছোট শিশুটাও শিখবে অন্যের অনুমোদন বা প্রশংসাই জীবনের সবকিছু। যার ফলে সস্তা প্রচার বা জনপ্রিয়তা অর্জনই হয়ে উঠবে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আর কোনো বিকৃত মস্তিষ্ক বহনকারী ব্যক্তির নোংরা মন্তব্যই তাকে পৌঁছে দেবে হতাশার চূড়ান্ত পর্যায়ে।
ফেসবুকের ভালো দিকও নেহাত কম নয়। বর্তমানে কোনো ভুক্তভোগীর বিচার নিশ্চিতকরণে যে ভূমিকা রেখে চলেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ফেসবুকের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই। আমি নিজেও একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী। শুধু বলতে চাই, ‘আমি ফেসবুককে নিয়ন্ত্রণ করব, ফেসবুক আমাকে নয়।’
ফাতেমা তুজ জোহরা
গণিত বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই–মেইল: [email protected]