‘আজ রবিবার’, ‘হাড়কিপ্টে’, ‘সাকিন সারিসুরি’, ‘৪২০’ নামগুলো শুনলেই আমাদের অনেকের মনে এক নস্টালজিক অনুভূতির উদ্ভব হয়। একসময় অনেক গুণী ও মেধাবী পরিচালকের নির্মিত নাটকগুলো ছিল সারা দেশের মানুষের সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম। অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাত্রার চিত্রপটে নির্মিত নাটকগুলো ছিল গ্রাম থেকে শহরের বাস্তব জীবনের নানা সুখ–দুঃখের ঘটনার প্রতিচ্ছবি। কীভাবে কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় আচরণ বাংলাদেশের মানুষের মনে এবং সমাজে আবর্তিত হয়, তার অনেক কিছুরই দর্পণ ছিল নাটকগুলো। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে দেখার মতো নির্মাণ ছিল সেসব টিভি নাটক।
কিন্তু বর্তমানে তুলনামূকভাবে মানসম্মত টিভি নাটক নির্মাণের চেয়ে মানহীন, কুরুচিপূর্ণ সংলাপে ভরপুর অনেক টিভি নাটক আমরা দেখছি।
সম্প্রতি নির্মিত অনেক নাটকের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, ব্যবসায়িক স্বার্থে এসব কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল নির্মাণগুলো তৈরি করা হচ্ছে। যার ফলে দর্শকদের মনে একধরনের নেতিবাচক চিন্তাচেতনার সৃষ্টি হচ্ছে। আরও লক্ষ করলে দেখা যায়, এসব টিভি নাটকের দর্শকের অধিকাংশই তরুণ প্রজন্মের। যার ফলে বিষয়টি সমাজে আরও গভীরভাবে তার খারাপ প্রভাব ফেলছে। এসব টিভি নাটকের বিষয়বস্তু সমাজে সেভাবে স্বীকৃত না হওয়ার কারণে পরিবারের সামনে এগুলো দেখার কথা ভাবাই যায় না। অনেক নাটকে নারীদের নিয়ে অসম্মানজনক ডায়ালগ বলা হচ্ছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
তবে অনেকের মতামত এমন যে, ‘নাটক তো বিনোদনের মাধ্যম। এখানে শেখার তেমন কিছু নেই, সব বিনোদনের জন্য।’ তাদের কাছে আমার কিছু প্রশ্ন যে, মানুষের সামাজিকীকরণের অংশ কি বিনোদন নয়? একজন শিশু বা তরুণ যখন এ ধরনের নির্মাণ দেখবে, তখন কি তার মনে এসব প্রভাব ফেলবে না? একজন তরুণ যখন দেখবে কোনো মেয়ের উদ্দেশে কিছু বাজে কথা ছুড়ে দিলে তার মনোযোগ পাওয়া যায়, তখন কি সমাজে ইভ টিজিংয়ের মতো নোংরা কাজের ছড়াছড়ি হবে না? যখন একজন তরুণের সামনে মাদক গ্রহণ খুব ‘হিরোইজমের’ ব্যাপার, তখন কি সমাজে মাদকের বিস্তার হবে না?
বর্তমানে যে দেশে ভালো নাটক নির্মাণ হচ্ছে না, বিষয়টি এমনও না। মানসম্মত এবং রুচিসম্মত অনেক টিভি নাটক এখনো নির্মিত হচ্ছে। তবে তার পরিমাণ দিন দিন কমছে বৈ বাড়ছে না। যার ফলে আমাদের দেশে বিদেশি টিভি চ্যানেলের প্রভাব বেড়ে যাচ্ছে। দেশীয় টিভি নাটকের জায়গায় আজ বিদেশি টিভি সিরিয়ালে দেশ ভরে গেছে, যা দেশীয় টিভি নাটক শিল্পের জন্য অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের গর্ব করার মতো টিভি নাটক শিল্প আছে, তা–ও কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে, যেমনি করে কাটপিস সিনেমার অন্তরালে হারিয়ে গেছে বাংলাদেশি সিনেমার স্বর্ণালি যুগ। তবে বর্তমানে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের কিছু কিছু ভালো কাজ আশার আলো দেখাচ্ছে।
তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ও সচেতন সমাজের এগিয়ে আসা খুবই জরুরি। আমরা কখনোই চাই না বাংলা চলচ্চিত্রের মতো দুর্দশা টিভি নাটক শিল্পেও হোক। আমরা সুস্থ বিনোদন চাই। তরুণ প্রজন্মের সুস্থ সামাজিকীকরণ চাই। পরিশেষে, দেশীয় শিল্প সংস্কৃতি তথা দেশীয় টিভি নাটকের সুদিন ফিরে আসুক, এমনটাই প্রত্যাশা করছি।
বাধন সরকার
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ই–মেইল: [email protected]