শম্ভুপুর গ্রামের জান্নাত বেগম অল্প শিক্ষিত একজন নারী। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর পড়াশোনা করতে পারেননি। তাঁর অনেক ইচ্ছা থাকলেও বিয়ের পর গ্রামে কোনো ভালো সুযোগ না থাকায় তাঁর আর পড়াশোনা হয়নি। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, যে করেই হোক তাঁর ছেলে বা মেয়েকে তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। বিয়ের তিন বছর পর তাঁর কোলজুড়ে একটা ফুটফুটে ছেলেসন্তান আসে। তিনি তাঁর নাম রাখলেন বিজয়। তাঁর ধারণা, বিজয় নামের ছেলেরা কখনো হারে না। হারতে জানে না।
ছেলে বিজয় ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, মা জান্নাত বেগমের মনের ইচ্ছাও দিন দিন প্রবল হচ্ছে। ছেলের চার বছর বয়স থেকে নিজেরে লালিত স্বপ্নের কথা মাথায় রেখে নিজেই নিজের ছেলেকে পড়াশোনা করানো শুরু করলেন। ছেলে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, মা তাঁর সন্তানকে পড়াচ্ছেন। ছেলে অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর জান্নাত বেগম তাঁর মনের ইচ্ছার কথা ছেলে বিজয়ের কাছে প্রকাশ করেন। তিনি চান, বিজয় একদিন দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।
বিজয় পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট নিয়ে উত্তীর্ণ হন। এখন তাঁর স্বপ্ন দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেকোনো একটিতে পড়া। কিন্তু বিপত্তিটা এখানে ঘটে। শহরে তাঁর পরিচিত কোনো লোকজন নেই, যাঁর কাছে থেকে তিনি ভর্তির প্রস্তুতি নিতে পড়বেন।
শহরে কোচিং করা, সেটা বিজয়ের সামর্থ্যেরও বাইরে। গ্রামাঞ্চলেও তেমন কোনো ভালো কোচিং সেন্টার নেই, যেখান থেকে তিনি ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে পারেন। এমনকি গ্রামে ইন্টারনেটের ব্যবস্থাও উন্নত নয় যে সেখান থেকে তিনি অনলাইনের মাধ্যমে কোচিং করবেন। তখন তিনি কোনো কিছু না পেয়ে গ্রামে খোঁজ করতে থাকেন একটি পাঠাগারের, যেখান থেকে তিনি সব ধরনের জ্ঞানার্জন করতে পারেন। কিন্তু তিনি আবিষ্কার করেন, তাঁর ইউনিয়ন, এমনকি তাঁর উপজেলাতেও একটি উন্মুক্ত পাঠাগার নেই।
বিজয় তখন একটা গ্রন্থাগারের খুব প্রয়োজন অনুভব করেন। যেখান থেকে তিনি নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারবেন। অর্জন করতে পারবেন তাঁর ভর্তি পরীক্ষার জন্য সব জ্ঞান। গ্রন্থাগার মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। এটি জ্ঞানের ভান্ডার, সংশোধনের শক্তি এবং সম্প্রদায়ের একটি অগ্রণী অংশ। লাইব্রেরি বই, ম্যাগাজিন, জার্নাল, ডেটাবেজ, ইলেকট্রনিক রিসোর্স ইত্যাদি সরবরাহ করে, যা সমাজের সদস্যদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি শিক্ষা, অনুসন্ধান, নীতিনির্ধারণ, বিচার, সৃজনশীলতা এবং ব্যক্তিগত উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিজয়ের উপজেলার মতো বাংলাদেশে অনেক উপজেলাতেই নেই উন্মুক্ত পাঠাগার বা গ্রন্থাগার, যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করতে পারবেন। বাংলাদেশের গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে মোট ৭১টি পাবলিক লাইব্রেরি আছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিমালিকানায় দুই হাজারের বেশি লাইব্রেরি থাকলেও এর অনেকগুলোই সবার জন্য উন্মুক্ত নয়।
প্রতিটি উপজেলায় উন্মুক্ত পাঠাগার না থাকার কারণে হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। বিজয়ের মায়ের মতো শত শত মায়ের ইচ্ছা, আশা-আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হচ্ছে। বইবিমুখ, সৃজনশীলতা-বিবর্জিত একটি প্রজন্ম গড়ে উঠছে। সমৃদ্ধ জাতি গঠনে গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরির বিকল্প নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ আলোকিত প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য গ্রন্থাগারগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রজন্মকে বইপড়ায় জ্ঞানচর্চায় মুক্তচিন্তায় উৎসাহিত করতে হবে এবং তার জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিটি উপজেলাতে একটি মডেল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশে অবকাঠামোগত অনেক ঈর্ষণীয় উন্নয়ন হয়েছে, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঘটেছে; কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও মননশীলতার কি সে ধরনের কোনো উন্নয়ন হয়েছে?
আমাদের সমৃদ্ধির পথে এগোতে হলে, একটি সৃজনশীল প্রজন্ম ও মননশীল জাতি গড়ে তুলতে হলে ইউনিয়নে ইউনিয়নে, গ্রামে গ্রামে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা চাই না বিজয় ও তাঁর মায়ের মতো আর কোনো মা-ছেলের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যাক।
হাসনাইন রিজেন
শিক্ষার্থী, শম্ভুপুর শাহে আলম মডেল কলেজ।
ই-মেইল: [email protected]