হারুন চাচা গ্রামে হেঁটে হেঁটে আচার বিক্রি করেন প্রায় ২০ বছর ধরে। তাঁর চার মেয়ে। একজন বিবাহিত, বাকি তিনজনের বিয়ে দিতে হবে। চাচাকে দেখে বললাম, ‘চাচা এখনো আচার বিক্রি করছেন?’ জবাবে বললেন, ‘বাবা, মেয়ে তিনডার বিয়ে দেওয়ার বোঝাটা এহনো মাথার ওপর আছে। দুপুর পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে হাইট্টা আচার বিক্রি করি। দুপুরে দুইডা খাইয়া আবার জমিতে যাই ঘাস কাটার জন্য। একটা গরুও পালি। মেয়েগুলারে বিদায় করতে হলে যে অনেক টাকাপয়সার দরকার বাজান।’
প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় চাচাকে স্কুলে আচার বিক্রি করতে দেখতাম, চাচা এখনো আচার বিক্রি করেন। সেই সুবাদে চাচার মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার বোঝার ভার সম্পর্কে জানতে পারলাম। বাংলাদেশের অনেক পরিবারের গল্প হারুন চাচার মতো। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত—সব পরিবারেই এমন সংকট আমরা দেখি।
প্রশ্ন হলো, মেয়েদের বিয়ে দেওয়া বোঝা হয়ে দাঁড়ায় কেন? কোনো ধর্মে তো বিয়েকে কঠিন করা হয়নি। আসলে বিয়েকে কঠিন করেছে আমাদের এই সমাজ। সমাজের মানুষজন। এই সমাজে গড়ে উঠেছে এক অদৃশ্য সংস্কৃতি। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সময় শ্বশুরবাড়ির শত শত লোক খাওয়াতে হবে, লেপ-তোশক দিতে হবে, যৌতুকের নামে খুশি হয়ে টাকাপয়সা দিতে হবে, আত্মীয়স্বজন দাওয়াত করতে হবে। লাখ লাখ টাকার আয়োজন করেও সবাইকে খুশি করা মুশকিল। না হলে যে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় না! এই হচ্ছে সমাজের তিলে তিলে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের ঘাড়ে জুড়ে বসা অসহনীয় কিন্তু অবশ্য পালনীয় সংস্কৃতি।
মেয়ের বিয়ের সময় ঘটা করে আয়োজন করতে না পারলে তো সমাজ বাঁকা চোখে দেখে। পাত্রপক্ষের আবদারের সীমার অন্ত নেই। টাকা দিতে হবে, মোটরসাইকেল কিনে দিতে হবে, বিদেশে পাঠাতে হবে, কত কিছু! এত এত নিয়মকানুন, প্রথা, দাবিদাওয়া পূর্ণ করার জন্য ভার এসে পড়ে পরিবারের সবচেয়ে পরিশ্রমী ব্যক্তিটার ওপর। তিনি হচ্ছেন বাবা, যিনি নিজের সুখ, আহ্লাদ সবকিছু বছরের পর বছর বিসর্জন দিয়ে রাতদিন একাকার কষ্ট করে যাচ্ছেন, শুধু ছেলেমেয়েদের ভালোর জন্য।
সমাজ চিন্তা করে না, কীভাবে স্বল্প আয়ের এই ব্যক্তি লাখ লাখ টাকার ব্যবস্থা করবেন, কীভাবে শত শত লোকের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করবেন, কীভাবে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির বিভিন্ন আবদার রক্ষা করবেন? তাঁর কাছে এত এত আবদারের জন্য অঢেল টাকা নেই, উচ্চ বেতনের চাকরি নেই। তিনি দিনমজুর। দিন আনেন দিন খান। সমাজের এই অসুস্থ সংস্কৃতি তাঁর জন্য সত্যিই একপ্রকার বোঝা, মানসিক নির্যাতনের সমান।
তাঁকে তখন নামতে হয় মানসিক অশান্তির যুদ্ধে। টাকাপয়সা জোগাড় করতে হবে। সুদে টাকাপয়সা ধার নিতে হবে, ব্যাংকঋণ করতে হবে, কিস্তি তুলতে হবে। এভাবে তিনি মেয়ের বিয়ের বোঝা সরাতে গিয়ে নতুন নতুন বোঝার ভার মাথায় তুলে নিচ্ছেন। কিন্তু তিনি অসহায়। অনেক পরিবারের ভাগ্যে এমন করুণ ভবিষ্যৎই লেখা থাকে।
বিয়েটাকে আমরা কঠিন করে তুলেছি, অর্থনৈতিক করে তুলেছি, সামাজিক মান-মর্যাদা রক্ষার বাহন হিসেবে উপস্থিত করেছি, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর বোঝা বানিয়েছি। কিন্তু মেয়েদের বিয়ে দেওয়া অনেক সহজেই সম্পন্ন করার উপায় ছিল।
ঘটা করে আয়োজন করলেই, লাখ লাখ টাকা ধার করে আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী খাওয়ানোর মধ্যেই একটা সম্পর্কের সাফল্য নির্ভর করে না। সম্পর্কের সফলতা নির্ভর করে মানুষ দুটোর ওপর, পরিবার দুটোর ওপর। মেয়ের পরিবারের যতটুকু সামর্থ্য, তা দিয়েই মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। বিয়ে যেন কোনো বোঝা না হয়ে ওঠে।
বাবার কাছে মেয়ে হলো রাজকন্যা। রাজকন্যাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য বাবারা কোনো কিছুর কমতি রাখেন না। সাধ্যের মধ্যে সব করেন। কিন্তু সাধ্যের বাইরে কিছু করার প্রথা আমাদের এই সমাজে গেঁথে গেছে। আমাদের উচিত সমাজ থেকে এই করুণ প্রথা বাদ দেওয়া। এর জন্য আমাদের করণীয় আছে।
সমাজে বসবাস করা প্রত্যেক মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন হতে হবে। বিয়ে মানেই ঘটা করে আয়োজন করতে হবে—এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ছেলেপক্ষ এমন কোনো আবদার করবে না, যেন তা মেয়েপক্ষের পরিবারের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সমাজে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে দুটি পরিবারের একত্রীকরণ যেখানে ছেলেমেয়ে ভালো থাকাটাই প্রধান উদ্দেশ্য; সেখানে আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন ও প্রয়োজন বা দাবিদাওয়া যেন মুখ্য বিষয় না হয়ে ওঠে।
সমাজের প্রত্যেক মানুষ এই চিন্তাধারায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে মধ্যবিত্তের কাছে মেয়ের বিয়ে আর বোঝা হয়ে উঠবে না। ঘটবে না পারিবারিক অশান্তি এবং আত্মহত্যার মতো ঘটনা। আসুন বাবাদের জীবনকে একটু স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলি, তাঁদের বোঝার মধ্যে না ফেলি, বিয়েটাকে সহজ করি।
আল আমিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]