শিক্ষার ক্ষতি পূরণে চাই খোলা মন ও নিরীক্ষার পথ

কোভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতের একটি শিক্ষা। মহামারিতে শিক্ষার ক্ষতি ও উত্তরণ নিয়ে গ্লোবাল এডুকেশন এভিডেন্স অ্যাডভাইজারি প্যানেল (জিইইএপি) সম্প্রতি যৌথভাবে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

জুমের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর ইংরেজি বিভাগের প্রধান আয়েশা কবির

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর একটি শিক্ষা। জিইইএপির প্রতিবেদন জানাচ্ছে, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এক বছর হারানো মানে দীর্ঘ মেয়াদে তাদের তিন বছরের শিক্ষার ক্ষতি। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যালয়গুলো টানা ১৮ মাস এবং পরে আরও এক মাস বন্ধ ছিল। সম্ভবত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘটনা এটি। শিশুদের শিক্ষার এ ক্ষতিটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। ভারতের অন্যান্য অংশেও দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ ছিল। সুতরাং, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা যে খুব ব্যতিক্রম, সে রকম আমি মনে করি না।

শিক্ষায় এ বিরতির প্রভাব সামনাসামনি যা দেখা যাচ্ছে, তার চেয়েও অনেক বেশি ও বড়। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থায় এ প্রভাব গোচরীভূত হয় না। কোনো শিক্ষার্থী যদি তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর ১৮ মাস বিদ্যালয়ে না যায়, তার মানে কী দাঁড়ায়? শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর মানে হচ্ছে সেই শিক্ষার্থী এখন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষা শেষ করতে চলেছে। কিন্তু এ সময়কালে সেই শিক্ষার্থী প্রকৃতপক্ষে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর স্তরকে সমন্বয় করা হলো না। প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের স্তর অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়ার ধারণাটি তুলে ধরা হয়েছে।

ধারণাটি হচ্ছে, একই শ্রেণিকক্ষের মধ্যে শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন স্তরে রয়েছে। কিন্তু শিশুদের আলাদা স্তর অনুযায়ী শিক্ষা না দিয়ে একটা শ্রেণিতে সবাইকে একই শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এটা যখন করা হচ্ছে, তার অর্থ দাঁড়ায় শিশুরা দেড় বছর বা ১৮ মাস স্কুলে আসেনি, তাতে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে বড় ধরনের ছেদ পড়েছে, সে বিষয়টা উপেক্ষা করা হলো। এর ফলাফল কী? শিশুদের এমন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যেটা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে কী ঘটেছে বলে মনে করেন?

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলাদেশে কী ঘটছে, সে সম্পর্কিত নিশ্চিত তথ্য আমার কাছে নেই। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের যে তথ্য আছে, তার মধ্যে সাদৃশ্য আছে। তৃতীয় শ্রেণিতে এখন যারা পড়ছে, প্রকৃতপক্ষে এখন তারা প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তবু তাদের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই শিশুরা এরই মধ্যে ভুগেছে। এখন তাদের পঞ্চম শ্রেণি অথবা চতুর্থ শ্রেণির শেষ পর্যায়ের পাঠ্যবই পড়ানো হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে শিশুরা ভাবছে, তাদের যে বিষয়গুলো পড়ানো হচ্ছে, সেগুলো পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা মনে করছে, সেগুলো পড়ে কিছুই তারা শিখতে পারছে না। এর ফলে তারা হাল ছেড়ে দিচ্ছে। শিক্ষকেরা যেটা পড়াতে চাইছেন, সেটা শিক্ষার্থীদের বোঝাতে না পেরে তাঁরাও হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি পিছিয়ে পড়ছে।

শিশুরা প্রকৃতপক্ষে কোন স্তরে আছে, সেটার প্রতি মনোযোগ দেওয়াটাই হবে এখনকার মূল বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টাতে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষিত মা–বাবা এবং যাদের অনলাইন ক্লাস করার সুবিধা ছিল, সম্ভবত তাদের অবস্থা ঠিক আছে। কিন্তু কম সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুদের ক্ষেত্রে অবশ্যই অবস্থাটা ভিন্ন। এ মুহূর্তে একই শ্রেণির শিশুদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ স্তরে ভাগ করে শিক্ষা দিতে হবে। মৌলিক ধারণা না হলেও এ ধারণার একটা নিয়মতান্ত্রিক চর্চা এখন প্রয়োজন।

পাঠ্যসূচির সমন্বয় করা প্রয়োজন। শিক্ষকসমাজের কাছে এখন যেকোনোভাবে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি যে শ্রেণিকক্ষে শিশুদের অংশগ্রহণ সক্ষম করার দায়িত্ব তাদের, পাঠ্যসূচি শেষ করার নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, সেটা করা হচ্ছে না।

প্রশ্ন :

এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়নের সঙ্গে নীতি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, সরকারের সিদ্ধান্তের মতো আরও অনেক বিষয় জড়িত। জিইইএপির প্রতিবেদনে কি আপনারা এ বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা দিয়েছেন? এর বাস্তবায়নটা কীভাবে হবে?

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: আমি যে বিষয়টার কথা বলছি, সেটা একটা সাধারণ ধারণা। ভারতে আমরা এই বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিষয়টা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেটাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল প্রশ্ন। শিক্ষকদের নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই। বার্তাটি ওপর থেকে যেতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।

ভারতে ‘প্রথম’ নামের এনজিও খুবই নির্ভরযোগ্য একটা পরীক্ষা পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছে, যার মাধ্যমে সহজেই শিশুদের শিক্ষার স্তর নির্ণয় করা যায়। এর জন্য মাত্র ৫-১০ মিনিট সময় লাগে। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টা আমাকে আশাবাদী করে তোলে তা হচ্ছে বেশি বয়সী শিশুরা দ্রুত শেখে।

প্রশ্ন :

মহামারিকালে অনলাইন শিক্ষা একটা বিকল্প হিসেবে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশেরই কেবল সেটা গ্রহণের সামর্থ্য ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচলিত যে বৈষম্য, সেটারই বহিঃপ্রকাশ। মহামারি থেকে আমরা কি এমন কোনো শিক্ষা নিতে পারি, যেখানে এ বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরা যায়?

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: মহামারি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে সরাসরি যে শিক্ষা গ্রহণ করত, তার বিকল্প হিসেবে কয়েক ধরনের অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি আমরা দেখতে পেয়েছি। এগুলোকে সমতাবাদী করে তোলার যথেষ্ট উপকরণ আছে। এটা অনেক পুরোনো ধারণা। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে নিকারাগুয়ায় রেডিওতে গণিত শিক্ষা দেওয়া হতো। বিশ্বব্যাংক সমীক্ষা করে পেয়েছিল, রেডিওতে শিক্ষা দেওয়ার ফলে অনেক বড় অর্জন ঘটেছে। শিক্ষা উচ্চ প্রযুক্তির হতে হবে, এমনটা নয়। রেডিওর মাধ্যমে কিংবা খুদে বার্তার মাধ্যমেও সেটা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে মুঠোফোন রয়েছে। স্মার্টফোন না হলেও সেগুলোতে তারা বার্তা পেতে পারে। রেডিও খুব সহজলভ্য ও সস্তা প্রযুক্তি। রেডিও, টেলিভিশন, মুঠোফোনে খুদে বার্তা—যেটাই পারো, সেটাই ব্যবহার করো। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট হতে হবে, এমন তো কথা নেই। ট্যাবলেট ব্যবহারের যে অভিজ্ঞতা, সেটা যে আরও কতটা মিশ্র হতে পারে, সেটা চিন্তাও করা যাবে না। প্রযুক্তি বলতে কী বোঝায়, সে সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই খোলা মনের হতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে ল্যাপটপ নয়, এটা হতে পারে রেডিওতে।

আমরা আমাদের প্রতিবেদনে যে বিষয়টিতে জোর দিয়েছি সেটি হলো, আমাদের খোলা মনের এবং নিরীক্ষাধর্মী হতে হবে। নিরীক্ষাগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে। সবকিছুকে এক পন্থায় কিংবা সনাতন পদ্ধতির স্কুলই একমাত্র পদ্ধতি—সে ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের বরং নিরীক্ষাধর্মী হতে হবে।

প্রশ্ন :

দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের ওপর বড় প্রভাব পড়েছে। বাল্যবিবাহের হার বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: যে শিশুদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের আবার শ্রেণিকক্ষে ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। তাদের আমরা পরিত্যাগ করতে পারি না। সেটা একটা অপরাধ। এ ক্ষেত্রে মানুষ যাতে সাড়া দেয় এবং কন্যাশিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রশ্ন :

এ নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে সুড়ঙ্গের শেষে কিছু আলোকরেখা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন?

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: আমার মনে হয়, আলো আছে। আমি সেই আলো আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারব না। কিন্তু আপনাদের যদি অঙ্গীকার থাকে, তবে সেই আলো আপনারাই খুঁজে পাবেন। অঙ্গীকারটা নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে আসতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: আপনাকেও ধন্যবাদ।