>এএফএম সোলায়মান চৌধুরী। চারদলীয় জোট সরকারের সময় জনপ্রশাসন সচিব ছিলেন। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিবসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ফেনীর জেলা প্রশাসক থাকার সময় আলোচিত হন সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে খ্যাত জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে। অবসরের পর তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়ে কুমিল্লা-৯ আসন থেকে দলের মনোনয়ন পান। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন। ২ মে তাঁর নেতৃত্বে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)র আত্মপ্রকাশ হয়। তিনি পার্টির আহ্বায়ক। গত ৫ মে রাজধানীর বিজয়নগরে এবি পার্টির কার্যালয়ে সোলায়মান চৌধুরী প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর সাবেক দল জামায়াতসহ নিজের নতুন দল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সেলিম জাহিদ।
প্রথম আলো: ছিলেন জামায়াতে ইসলামীতে, এখন নতুন নামে দল করলেন। আসলে জামায়াতের সঙ্গে এবি পার্টির পার্থক্যটা কী?
সোলায়মান চৌধুরী: মৌলিক পার্থক্যটা হচ্ছে এক্সক্লুসিভ (বিশেষ জনগোষ্ঠী) এবং ইনক্লুসিভ (সবার অংশগ্রহণ)। আমরা একটা ইনক্লুসিভ পার্টি। আমাদের পার্টিতে সকল মতের, সকল পথের, সকল ধর্মের, সকল চিন্তার, সকল চেতনার লোকজন আসতে পারবেন এবং এসেছেন। এটিই হলো আমাদের সঙ্গে আরও কিছু পার্টির মৌলিক তফাৎ। কিছু কিছু দল আছে, তারা বিশেষ একটা ধর্মের অথবা বিশেষ একটা শ্রেণি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের আমরা ইনক্লুসিভ বলতে পারি না। আরও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা কোনো ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দল নই। আমরা সেবামূলক রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
প্রথম আলো: তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, জামায়াত ইনক্লুসিভ না, বা এই দলটি সবার জন্য নয়?
সোলায়মান চৌধুরী: এই দলে তো সবাই যেতে পারে না। কোনো হিন্দু, কোনো বৌদ্ধ, কোনো খ্রিষ্টান—তাঁরা কিন্তু ওই দলের প্রাথমিক সদস্য বলতে সমর্থক হতে পারেন। জামায়াতের আমির হতে পারবেন? এর উত্তর মনে হয় তারা (জামায়াত) ভালো দিতে পারবে।
প্রথম আলো: তাহলে এবি পার্টির সঙ্গে জামায়াতের পার্থক্য কেবল ইনক্লুসিভ আর এক্সক্লুসিভের জায়গায়ই সীমাবদ্ধ? জামায়াত ধর্মভিত্তিক দল, আপনাদের আদর্শিক ভিত্তি কী?
সোলায়মান চৌধুরী: আমাদের আদর্শিক ভিত্তি মূলত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতার যে অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার—এই তিন মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়াই হলো আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি।
প্রথম আলো: একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে আপনারা কীভাবে দেখেন।
সোলায়মান চৌধুরী: মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবিস্মরণীয় জাতীয় অর্জন হিসেবে দেখি। আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা বাস্তব প্রতিফলন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো ধরনের দ্বিধা, হীনমন্যতা, বিভক্তি ও বিদ্বেষ কোনো সুনাগরিকের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। আমরা স্বাধীনতাকে ধারণ করি, আমরা এটা অর্জন করেছি। আমরা মনে করি, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন। এবি পার্টি এই পাটাতনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর।
প্রথম আলো: এই কথাগুলো কি জামায়াতে ইসলামীতে থাকতে কখনো বলেছিলেন?
সোলায়মান চৌধুরী: জামায়াতে ইসলামি থেকে আমি বিদায় নিয়েছি। কাজেই কী বলতাম, কী না বলতাম, এ প্রশ্নটা বোধ হয় এখন আমাকে না করলে আমি খুব খুশি হব।
প্রথম আলো: জামায়াত ক্যাডারভিত্তিক দল। এবি পার্টির কর্মপদ্ধতিও কি একই হবে?
সোলায়মান চৌধুরী: প্রশ্নই আসে না। আমাদের দেশে মূলত কিছু ধর্মভিত্তিক দলে, কিছু সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্টপন্থী রাজনৈতিক দলে ক্যাডার সিস্টেম আছে। আমরা সকল শ্রেণি, সকল মত, সকল পথের, সকল ধর্মের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করব। আমাদের এখানে কোনো ক্যাডারের ভিত্তি থাকবে না। আমাদের দলটা কোনো তত্ত্ব বা মতবাদ প্রতিষ্ঠার কাজ করবে না।
প্রথম আলো: এবি পার্টি বা আমার বাংলাদেশ পার্টির নামকরণের কারণ কী। জামায়াতের স্বাধীনতা বিরোধিতার বিষয়টি মাথায় রেখেই কি এই নাম নির্বাচন?
সোলায়মান চৌধুরী: না, জামায়াতে ইসলামীর চিন্তা থেকে এই নামকরণ আসেনি। আমরা উন্মুক্তভাবে সারা দেশে কর্মী-সমর্থক ছাড়াও দেশের সুধীমণ্ডলী, যারা আমাদের পছন্দ করেন- এমন মানুষদের কাছ থেকে আমরা শতাধিক নাম পেয়েছি। বিভিন্নভাবে আমরা যাচাই-বাছাই করে সর্বশেষ ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ নামটি বেছে নিয়েছি।
প্রথম আলো: রাজনীতির মাঠে এবি পার্টির শত্রু বা মিত্র কারা হবে?
সোলায়মান চৌধুরী: সাদা চোখে আমাদের শত্রু নেই। মিত্র সবাই আছে কি না, এটা দেখার বিষয়। তবে কে শত্রু, কে মিত্র তা নির্ধারণ হবে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থের নিরিখে। আমরা যেহেতু মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করব। তাই আমি যদি কাউকে শত্রু ভাবি, তাহলে তার অধিকার কি আমি প্রতিষ্ঠা করতে পারব? সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কোনো শত্রু নেই।
প্রথম আলো: শত্রু-মিত্রের রাজনৈতিক সংজ্ঞা দিলেন, কিন্তু বহির্বিশ্বে আপনাদের মিত্র কারা? জামায়াত তো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলত।
সোলায়মান চৌধুরী: বিশেষ কোনো দেশ নয়। সবার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বের। গোলামির নয়, প্রভুত্বের নয়।
প্রথম আলো: প্রতিবেশী দেশ ভারতের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী হবে।
সোলায়মান চৌধুরী: একই সম্পর্ক হবে। এবং এই সম্পর্ক থাকতেই হবে। যেহেতু তারা আমার প্রতিবেশী। সুখে-দুঃখে তারা আমাদের পাশে, আমরা তাদের পাশে। আমি যদি বৈরিতা পোষণ করি, তো অন্যও আমার প্রতি বৈরিতা পোষণ করবে। ফলে সম্পর্ক খারাপ হবে। সম্পর্ক খারাপ হলে লেনদেন খারাপ হবে। সুযোগ-সুবিধা পাওয়া থেকে আমি যেমন বঞ্চিত হব, তেমনি আমার প্রতিবেশীও আমার কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে।
প্রথম আলো: নতুন দল, এখন দৃষ্টি নিশ্চয়ই কর্মী-সমর্থক সংগ্রহে। এবি পার্টির টার্গেট কারা, জামায়াত বা শিবির?
সোলায়মান চৌধুরী: সকল শ্রেণির মানুষ আমদের টার্গেট। বড় বড় রাজনীতিক থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সেনা কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী, সমাজসেবী, শ্রমিক, কৃষক, এমনকি একজন ভিক্ষুক—সব শ্রেণির মানুষই আমাদের টার্গেট। কারণ সব শ্রেণির মানুষ না পেলে তাদের অধিকার সম্পর্কে তো আমি জানব না। অতএব সবার অংশীদারত্বের ভিত্তিতে আমরা এই নতুন দল গড়তে চাই।
প্রথম আলো: কোনো জোটে যাবেন?
সোলায়মান চৌধুরী: এ মুহূর্তে কোনো জোটে যাওয়ার মতো সামর্থ্য এবং ইচ্ছা কোনটিই আমাদের নেই। দল গোছানো এবং দলের পক্ষে জনমত গঠনই এখন আমাদের মূল কাজ। তবে এটুকু বলতে পারি, এবি পার্টি কারও লেজুড়বৃত্তি করবে না। না বুঝে, না শুনে আমরা কোনো জোটে যাব না। যাওয়ার একটাই মোটিভ হবে, ওই দলের লোকজনের মন-মানসিকতায়, চিন্তা চেতনায়, কর্মসূচিতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় কি না। সেটাই হবে আমাদের কারও সঙ্গে জোটে যাওয়ার ভিত্তি।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগ যদি আপনাদের ডাকে, যাবেন?
সোলায়মান চৌধুরী: আমাদের যে মূলনীতি, তা হচ্ছে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। আবারও বলছি, তাদের কর্মসূচিতে যদি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি যুক্ত থাকে এবং তাদের নেতাদের এই মনমানসিকতা যদি থাকে, আলাপ-আলোচনা যদি এমন হয় যে, আমরা আশার আলো দেখি যে, তারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করবেন এবং মানুষকে মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেবেন তাহলে আমরা বিবেচনা করব।
প্রথম আলো: এবি পার্টির আত্মপ্রকাশের দিন আপনারা বলেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে নির্মাণ করেছেন, আপনারা সেই বাংলাদেশকে নতুন করে বিনির্মাণ করতে চান। বিষয়টি পরিষ্কার করবেন?
সোলায়মান চৌধুরী: স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের চেষ্টা হবে নতুন করে দেশকে বিনির্মাণের। এর মাধ্যমে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করব। তিনি (বঙ্গবন্ধু) ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। এখন বিনির্মাণের দায়িত্ব আমাদের সবার।
প্রথম আলো: নতুন দল গঠনের পর সাবেক দল জামায়াতের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?
সোলায়মান চৌধুরী: জামায়াত এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, এমন খবর পাইনি।
প্রথম আলো: জামায়াতে ইসলামীর ঘরানার বুদ্ধিজীবী শাহ আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেছেন দেশে নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা নেই। তাঁর বক্তব্য দেশে ডান, বাম, ইসলামি—সব ধরনের দলই সক্রিয় আছে। জায়গা খালি নেই।
সোলায়মান চৌধুরী: জনাব শাহ আবদুল হান্নান একজন বুদ্ধিজীবী, সাবেক সচিব। তিনি তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে, তাঁর পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে যেটা উত্তম মনে করেছেন, সে মন্তব্য করেছেন। আমরা মনে করি, অসংখ্য রাজনৈতিক দল থাকার মানে এই নয় যে, দেশে রাজনীতি ক্রিয়াশীল আছে। নতুন রাজনৈতিক দল গঠন এবং রাষ্ট্র মেরামতের কাজ করার জায়গা একদমই খালি পড়ে আছে।
প্রথম আলো: এবি পার্টির অনেকেই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে এসে জামায়াত সম্পর্কে আপনাদের মূল্যায়ন কী?
সোলায়মান চৌধুরী: আমি যেহেতু জামায়াতে ইসলামি থেকে পদত্যাগ করে এসেছি। আমার উচিত হবে না, নৈতিক হবে না, তাদের বিষয়ে কোনো কথা বলা।
প্রথম আলো: কিন্তু মানুষের তো জানার আগ্রহ আছে, কী কারণে আপনি দল ছেড়ে এলেন?
সোলায়মান চৌধুরী: একান্তই ব্যক্তিগত কারণে আমি দল ছেড়ে এসেছি। আমি ছেড়ে আসার সময়েই ঘোষণা দিয়েছিলাম যে, ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি।
প্রথম আলো: কিন্তু আপনার দলের সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকা আপনারা মেনে নিতে পারেননি।
সোলায়মান চৌধুরী: এটা সত্য কথা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে জামায়াতে ইসলামীর যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা আমরা মেনে নিতে পারিনি। আমরা চেয়েছিলাম জামায়াত প্রকাশ্যে ঘোষণা দিক এবং বলুক, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের যে ভূমিকা ছিল, সেটি ভুল ছিল। দুঃখজনক যে, সেটি তারা বলেনি। জামায়াতে ইসলামি তাদের কর্ম করে যাবে, আমাদের কর্মের মাধ্যমে মানুষ দেখবে তফাৎটা আসলে কোথায়।
প্রথম আলো: মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন। গুঞ্জন ছিল তিনি নতুন দলের সঙ্গে থাকবেন, ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনা আছে?
সোলায়মান চৌধুরী: আমাদের যখনই প্রয়োজন হয়, তখনই আমরা ওনার পরামর্শ, সহযোগিতা চাই। তিনি পরামর্শ দেন। সময়ই বলে দেবে তিনি এবি পার্টির দায়িত্বশীল পদে আসবেন কি, আসবেন না।
প্রথম আলো: দেশের অবস্থা কী, কি দেখছেন।
সোলায়মান চৌধুরী: দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে, এটা বলা মুশকিল। তবে সামনে ধূসর দেখছি। যে বিপদ (করোনাভাইরাস) আমাদের ওপর আরোপিত হয়েছে, এটি থেকে মুক্ত হওয়ার পর যে আর্থিক পরিস্থিতি, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব দেখা দেবে—এই বিপদ থেকে মুক্ত হতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। এই দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।