শিক্ষাব্রতী রাশেদা কে চৌধূরী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মহিলা ও শিশু এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। বর্তমানে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক। এর আগে তিনি এডাবের পরিচালক ও উইমেন ফর উইমেন–এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রথম আলো : সমাজে হঠাৎ কেন এত নিষ্ঠুরতা?
রাশেদা কে চৌধূরী : যা ঘটছে, তা অত্যন্ত বীভৎস। শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়, ধরনের দিক থেকেও। কেননা, তা সুস্থ মস্তিষ্কের কারও কাছে হয়তো বোধগম্য নয়। কিন্তু এদের যদি অসুস্থ বলি, তাহলে তা অন্য একটি ধারার দিকে যাবে। এরা অসুস্থ নয়, বিকৃত মানসিকতার। কিছুদিন ধরেই আমরা দেখছি, এটা বাড়ছে; শিশু, ছিন্নমূল নারী, আদিবাসী, এমনকি প্রতিবন্ধী নারী পর্যন্ত সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সমাজে যারা যত ভঙ্গুর ও অসহায়, তারাই তত বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
প্রথম আলো : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এম আই মাহবুব কিন্তু অবাক হতে চান না। তাঁর মতে, বহুকাল ধরেই পাশ্চাত্যসহ বিভিন্ন সমাজের মধ্যে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলে আসছে। সমাজে এর একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে।
রাশেদা কে চৌধূরী : এই বিশেষজ্ঞ মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও বলব, আমি এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই। এটা সত্য যে দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার অনাদিকাল ধরে চলে আসছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির যুগে যেখানে দাবি করি যে আমরা সভ্য ও একটা গণতান্ত্রিক ভাবধারার মধ্যে আছি। এর মধ্যে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষের মধ্যে যখন ন্যায়বোধ লোপ পায়, যখন বিকারগ্রস্ততা আসে। কতগুলো নীতিবোধ যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে মানা হতো। সরাসরি জনসমক্ষে অপরাধ সংঘটনের দুঃসাহস মানুষের আগে ছিল না, যা ছিল তা অল্প। আকাশ সংস্কৃতির একটি প্রভাব আমাদের মধ্যে আছে। এটা একধরনের বিকারগ্রস্ততা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালনে সহায়ক হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে এসব ঘটলে প্রশাসন ও বিচার বিভাগ সবার আগে এগিয়ে আসে। স্কুলে ঢুকে গণখুনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেছে, কিন্তু অপরাধীকে শাস্তি দিতে তাদের সময় লাগেনি।
প্রথম আলো : আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান খুব নিচে, গত এক মাসে ১৩টি নৃশংস শিশু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বছরে ১০০-র বেশি শিশু হত্যার শিকার হচ্ছে।
রাশেদা কে চৌধূরী : মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো হলো প্রতিরোধক আর প্রতিষেধক। যেমন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সমাজ সবকিছু একটা নড়বড়ে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ব্লগার ওয়াশিকুর খুনের সময় একজন বৃহন্নলা এগিয়ে এসেছিলেন, অন্য অনেকে আসেননি। রাজনের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ভিডিও যাঁরা তুলেছেন, মনে হয়েছে তাঁরা সেটা উপভোগ করেছেন এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে একটা বাহবা নিতে চেয়েছেন। এসব কিন্তু আমাদের ছিল না। বীভৎসতার যে ধরন সেটা কিন্তু সাম্প্রতিক, অবশ্য বলব না যে, এটা কেবল বাংলাদেশেই ঘটছে। জঙ্গিগোষ্ঠী যখন জবাই করে, তখন সেটাও তো কোনো নীতিনৈতিকতার মধ্যে পড়ে না।
প্রথম আলো : তবে কি বলবেন, বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চলছে, যেখানে প্রভাবশালীদের দায়মুক্তি চলছে, সেটাই এমন সহিংসতার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
রাশেদা কে চৌধূরী : আমি স্বীকার করি, পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতির কারণে এটার জন্য অনেকটা দায়ী। কারণ, আমি জানি অপরাধ করলে, হয় অর্থ, নাহয় প্রতিপত্তির বিনিময়ে অথবা কোথাও না কোথাও, কারও না কারও ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় পেয়ে আমি পার পেয়ে যাব। যারা ইদানীং এসব অপরাধ করেছে, তারা কেউ ৫০-এর ওপরে নয় এবং কেউ লেখাপড়া অজানা নয়। তাহলে শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ তৈরি করার কথা, সেটাও পারা যাচ্ছে না।
প্রথম আলো : তাহলে শিক্ষাব্যবস্থায় কি কোনো গলদ আছে?
রাশেদা কে চৌধূরী : শিক্ষার বড় উদ্দেশ্য জ্ঞান ও অালোকিত মানুষ তৈরি করা। যদি তারা কূপমণ্ডূকতার মধ্যে থাকে, তাহলে সেটা শিক্ষা নয়। শিক্ষা মানুষের মনকে পরিশীলিত করে, কিন্তু সেখানে যদি তার মূল্যবোধই হারিয়ে যায়, সেই শিক্ষাকে শিক্ষা বলা যাবে না। আমি মনে করি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি এখন দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে। আমরা যদি পেছনে দৃষ্টি ফেরাই, আমাদের প্রজন্মে শিক্ষকেরা একটা বিশাল ভূমিকা পালন করতেন। ‘সদা সত্য কথা বলিব’, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’ এমন সুবচনগুলো এখন নির্বাসিত হয়েছে। এখন মোবাইলের মাধ্যমে আপনি খুদে বার্তা পাঠাচ্ছেন। পাঁচ বছরের আগেই বাচ্চারা এসব পেয়ে যাচ্ছে এবং তা আমাদের শাশ্বত মূল্যবোধকে একেবারে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। আমাদের মূল্যবোধের মধ্যে ছিল মুরব্বিদের কথা শোনা, শিশুদের ভালোবাসা। বাবা-মা ও শিক্ষকেরা যে তাদের মারধর করত, সেটা যদিও ছিল। কিন্তু তা এমন পর্যায়ে কখনো ছিল না।
প্রথম আলো : আমরা কোথাও আটকে গেছি কি না। আওয়ামী লীগের হাতে আওয়ামী লীগের কর্মী খুনেরও অসংখ্য ঘটনা আছে। সমাজে এর বিচারের দাবি নেই।
রাশেদা কে চৌধূরী : আমি এটাই বলতে চাইছিলাম। অনন্তকাল ধরে যেটা চলেছে, স্বৈরশাসন, সম্রাট সে সময় হয়তো এসব ছিল, কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, আপনি যেটা বললেন, আমরা একটা জায়গায় আটকে গেছি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্খলন হয়ে গেছে। সোজা কথায় যদি বলি, সেখানে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছি আমরা। এবং সেখানে এই যে রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে, আর সেটা কেবল কোনো একটি রাজনৈতিক সরকারের আমলে নয়। ১০০টা ধর্ষণের দম্ভোক্তি মনে আছে? সে নিজে দম্ভোক্তি ও স্বীকারোক্তির পরেও তার তো বিচার হয়নি। ওই ঘটনার পরে এই ধারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। যে কারণে আজকের নতুন প্রজন্ম রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে চাইছে না, তারা এর প্রতি খুবই বীতশ্রদ্ধ।
প্রথম আলো : নাগরিক সমাজও কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারছে না। তাহলে উপায়? সঠিক পথে চলা কীভাবে শুরু হবে?
রাশেদা কে চৌধূরী : আমি অবশ্য এটা সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করি না। আমি বিশ্বাস করি, এখনো মানুষ আছে, যাঁরা দাঁড়ান। তাঁরা সময় পেলে প্রতিবাদমুখী হন। তাঁরা অচেনা বলেই এখনো যেখানে যেটুকু বিচার হয়, তাঁদের কারণেই হচ্ছে। মানুষ এখনো অমানুষ হয়ে যায়নি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো একটা মূল্যবোধ আছে। কিন্তু তারা শক্তিহীন বলে বড় ভূমিকা রাখতে পারে না। পুরো
দেশই রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে আছে। আপনাদের মিডিয়ার মধ্যেও বিভক্তি আছে। যে যেভাবে সুবিধা পান, সেভাবে কথা বলেন, লেখালেখি করেন এবং নিশ্চয় এ কথা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার মধ্যে এখনো আছে, যারা তাদের
অবস্থান থেকে সোচ্চার এবং সে জন্য তাদের মাঝেমধ্যে মাশুল দিতে হয়। তবে এটা মানছি যে আমাদের মধ্যে একটা গা-সওয়ার
ব্যাপার হয়ে গেছে। আমরা ভাবি, অনর্থক কেন এর মধ্যে মাথা গলাব। আমাদের মান্ধাতার আমলের বিচারব্যবস্থার বদল নিয়ে
চিন্তা করা দরকার। রাজন হত্যার ভিডিও তো আদালতও দেখতে পাচ্ছেন। তারপরও তবে কেন আমাদের এই বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দেখতে হবে। কেন একে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা যাবে না। যত দেরি হয়, তত নানামুখী অনিয়ম মাথাচাড়া
দিয়ে উঠতে পারে। বেশির ভাগ ধর্ষণের মামলার বিচারে আপনি দেখবেন তা-ই ঘটে। এত ধীরগতিতে বিচার চলে যে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের কী হলো? এসব মানুষের মধ্যে দাগ কাটে।
প্রথম আলো : আমাদের পুরোনো মূল্যবোধ মরে গেছে। এখন নতুন মূল্যবোধ দিয়ে তাকে প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে আমরা দেখি, জাতীয় নেতৃত্ব পুঁজিবাদের যে নৈতিকতা থাকে, সেটা তাঁরা দাঁড় করাতে পারছেন না। আপনি কীভাবে দেখেন?
রাশেদা কে চৌধূরী : এখানে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো পারিবারিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করা। সেটা ভীষণ নড়বড়ে হয়ে গেছে। কিছুটা আর্থিক ও কিছুটা পরিবেশগত কারণে। এখন একটি বা দুটি সন্তান নিয়ে মা-বাবা দুজনই কর্মজীবী। তাই সন্তানেরা কোথায় কী করছে, তা দেখার সময় বা সুযোগ কোনোটিই তাঁদের নেই। সেখানে ভরসা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু আগে যে আমরা দরদি, নিবেদিতপ্রাণ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক দেখেছি, তাঁদের পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে কোচিং-বাণিজ্য। স্কুলেই এখন কোচিং চলে, অর্থের দিকে তাঁদের নজর, আর সে জন্য তাঁদের আবার পুরোপুরি দায়ীও করা যাবে না। কারণ, তাঁদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা অনেক কম।
প্রথম আলো : কী প্রত্যাশা?
রাশেদা কে চৌধূরী : যেকোনো নাগরিকের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। এখানে নিশ্চয় রাষ্ট্র ও সংসদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে। বিচার বিভাগ চেষ্টা করছে। তবে নির্বাহী বিভাগের গ্যাঁড়াকলে পড়ে যাচ্ছি আমরা।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদা কে চৌধূরী : ধন্যবাদ।