চাপ কমাতে সম্ভবত এই উদ্যোগ

প্রথম দফায় ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নিয়েছে সরকার।এ উদ্যোগ নিয়ে নানা মহলে রয়েছে ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া। এ বিষয়ে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবিরের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

হুমায়ুন কবির, সাবেক রাষ্ট্রদূত

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগকে কতটা যৌক্তিক মনে করছেন?

হুমায়ুন কবির: রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি জটিল আকার ধারণ করেছে। তাদের ফেরত পাঠানোর দুই দফা উদ্যোগ নিয়েও

আমরা সফল হতে পারিনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের জন্য সাহায্য–সহযোগিতাও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাচ্ছি না। অথচ আমাদের চাওয়া, রোহিঙ্গারা দ্রুত ফিরে যাক। এখন যতক্ষণ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হচ্ছে না, ততক্ষণ তাদের থাকা-খাওয়ার বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। তারই অংশ হিসেবে বর্তমান শিবিরগুলোর চাপ কমাতে সম্ভবত সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কিছু বিরোধিতা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরের মাধ্যমে সরকার হয়তো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বার্তা দিতে চাইছে যে আমাদের ব্যাপারে মনোযোগী না হয়ে মিয়ানমারের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া উচিত।

প্রশ্ন :

আপনি বললেন ভাসানচরে কিছু রোহিঙ্গা স্থানান্তরের ফলে বর্তমান শিবিরগুলোর ওপর চাপ কমবে। সেই সম্ভাবনা কতটুকু? ১০ লাখ রোহিঙ্গা তো কক্সবাজার–টেকনাফ এলাকায় থেকে যাবে।

হুমায়ুন কবির: আগেই বলেছি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কাজটিতে আমরা খুব সুবিধা করতে পারছি না। এমনকি প্রত্যাবাসন শুরু হলেও অনেক সময় লাগবে। এর একটা প্রস্তুতি সরকারের দিক থেকে থাকা প্রয়োজন। কিছু রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর তারই অংশ বলে মনে হয়। বর্তমান রোহিঙ্গা শিবিরগুলো নিয়ে সরকার সমস্যার মধ্যে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বিরোধ শিবির এলাকাগুলোর আশপাশে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে ও চিন্তাভাবনা করেই সরকার কাজটি করেছে বলে মনে হয়।

প্রশ্ন :

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকে সরকারের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছে কোন বাস্তবতা থেকে?

হুমায়ুন কবির: রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুক্ত করতে পারলে ভালো হতো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যারা বিরোধিতা করছে, তাদের কিছু উদ্বেগের জায়গা রয়েছে। যেমন সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা ও জীবন-জীবিকা কী হবে, সেটা তাদের উদ্বেগের কারণ। আমি মনে করি, এসব বিষয় কূটনৈতিকভাবে সামাল দেওয়ার সুযোগ আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এটা বুঝতে হবে যে বাংলাদেশকে এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে এবং ব্যবস্থাপনার কাজটি করতে হচ্ছে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি ভাসানচরের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চিন্তিত থাকে, তবে সেই সমস্যা কীভাবে দূর করা যায় বা সেখানে কীভাবে তারা সহায়তা করতে পারে—এসব বিষয় নিয়ে আমরা কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে পারি। ভাসানচরে এখন কিছু সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো সামনে নিশ্চয়ই দূর করা যাবে। এ বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে চাচ্ছে না, এমন অভিযোগও আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফে।

হুমায়ুন কবির: শরণার্থীদের স্থানান্তরের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় যাওয়ার বিষয়টি রয়েছে। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের এটা বোঝানো প্রয়োজন যে সেখানে গেলে ভবিষ্যতে কী সুবিধা সে পাবে। সেটা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার হোক বা অন্য যা–ই হোক না কেন। এভাবে কাজটি করা গেলে স্বেচ্ছায় তাদের স্থানান্তরের বিষয়টি যেমন নিশ্চিত করা যাবে, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সন্তুষ্ট থাকবে। রোহিঙ্গারা এখন যেভাবে আছে, সেখান থেকে অন্য কোথাও যেতে বললে তারা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কষ্টে থাকলেও বর্তমান শিবিরগুলোই তাদের কাছে আপন। নতুন কোথাও যাওয়ার বিষয়টি তাদের মনে বিচ্ছিন্নতার বোধ তৈরি করতে পারে। তাদের বোঝানোর মধ্য দিয়ে এই সংকট দূর করা যায়।