এডিস মশা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে
কবিরুল বাশার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। মশা বিষয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো: অকার্যকর মশার ওষুধ, সিটি করপোরেশনগুলোর অপারগতা ছাড়াও এটা কি ঠিক যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবার ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বেড়েছে?
কবিরুল বাশার: ১৯৫৩ সালের পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা শহরে সব থেকে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। তাপমাত্রার বৃদ্ধিও জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ফল। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক রোগের একটা সম্পর্ক আছে। বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। এডিসের ডিম শুকনো অবস্থায় ছয় মাস থাকতে পারে। আগের বছর অক্টোবরে এডিস যে ডিম পেড়েছিল, নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে চার মাসের মাথায় যখন বৃষ্টি হয়েছে, তখন এডিসের বড় একটি ব্যাচ মৌসুমের শুরুতেই তৈরি হয়েছে। এরপরের থেমে থেমে বৃষ্টির পর্বগুলোতে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করেছে।
প্রথম আলো: এটা তো তাহলে এই অঞ্চলের সব নগরীর জন্য প্রযোজ্য, কলকাতায় কেন এমন উদগ্র রূপ নেয়নি? ব্যর্থতা কোথায়?
কবিরুল বাশার: মশকনিধনে বাংলাদেশের কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। সিটি করপোরেশন শুধু সাধারণ কিউলেক্স মশাকে টার্গেট করে। তাতে এডিস থাকে না।
প্রথম আলো: প্রবীণ মশক বিশেষজ্ঞ তৌহিদ আহমেদ শনিবার আমাদের বলেছেন, ১৯৫৫ সালে প্রথম ম্যানিলায় জন্ম নেওয়া ডেঙ্গু ১৯৬৩ সালে কলকাতায় একটা মহামারি রূপ নিল। পরের বছর ‘ঢাকা ফিভার’ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে যেটা এল, সেটাই ডেঙ্গু। কিন্তু ২০০০ সালে ফিরে আসার পর থেকে তো চলছেই, তাহলে অবহেলা কেন? দেখার সংস্থা তো অনেক।
কবিরুল বাশার: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল। ২০১৪ থেকে প্রতিবছর শুধু ঢাকায় তিনটি করে করা ১২টি জরিপের ফল আমাদের হাতে আছে। গত বছর আমরা চট্টগ্রামেও করেছি, সেখানে তখন চিকুনগুনিয়াও হয়েছিল। চট্টগ্রামে করা ওই জরিপের ফল ছিল, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ ট্রান্সমিশনেও হতে পারে। ঢাকা থেকে রোগী গমনের দরকার পড়বে না। চট্টগ্রামে এডিসের ঘনত্ব উদ্বেগজনক, ৫০ শতাংশ ওয়ার্ডেই এডিস মশা আছে। প্রায় ৪০ জনের একটি জরিপ দল ঢাকার ৯৮টি ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানে দৈবচয়নের ভিত্তিতে জরিপ করে গত মার্চেই হুঁশিয়ার করে যে ঢাকায় এবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে। ওই জরিপ কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থায়নে এবং রোগ নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগের প্রধান সানিয়াত তাহমিনার তদারকিতেই হয়েছে। আমিও ওই দলে ছিলাম। এডিসের ঘনত্ব ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে যে বেশি, সেটা মৌসুমের শুরুতেই ওই জরিপে পরিষ্কার ছিল।
প্রথম আলো: আপনারা ওই জরিপ গত মাসেও করেছেন। আগের ফলাফলের সঙ্গে তফাত দেখলেন?
কবিরুল বাশার: অবশ্যই। ফেব্রুয়ারির চেয়ে জুলাইয়ে বৃষ্টি আরও বেশি হওয়ায় এডিসের ঘনত্ব আরও বেড়েছে। তাই চলতি আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। যদি কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণ এবং তার যথাযথ ব্যবস্থাপনা না করা হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে এই দুই মাসে। বৃষ্টি হলে কিন্তু অক্টোবরেও গড়াতে পারে।
প্রথম আলো: এডিস নিয়ন্ত্রণে এখনো ঠিক কোথায় ঘাটতি? কোথায় অগ্রগতি?
কবিরুল বাশার: চারটি টুলস লাগবে। এক. পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, দুই. জৈবিক ব্যবস্থাপনা, তিন. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ। যেমন ওষুধ দেওয়া। ওষুধ দিতে হয় দুটি স্থানে—পানিতে ও উড়ন্ত মশা মারতে। পানিতে বাচ্চা জন্মে, প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তারা বাতাসে ওড়ে। চার. জনগণকে সম্পৃক্ত করা। এই চারটির মধ্যে সিটি করপোরেশন করে তৃতীয়টি। বাকিটা তার বাজেটে থাকে না। এবার অবশ্য তারা মানুষকে যুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তারা যেভাবে চাইছে, সেভাবে হবে না। বছরব্যাপী পরিকল্পনা লাগবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে গবেষণা ও মূল্যায়ন টিম করে এডিস জরিপের ফলাফল মনিটর করতে হবে। তারা এডিসের ঘনত্ব ডেটা সিটি করপোরেশনকে দেবে। তারা সরেজমিনে দেখবে নিয়ন্ত্রণ হলো কি হলো না। না হলে প্রমাণিত হবে কর্মসূচি বা ওষুধ কোথাও ত্রুটি ঘটেছে। সমন্বিত মশকনিধন পরিকল্পনাই মূল প্রত্যাশা।
প্রথম আলো: কীটনাশকের অকার্যকরতা বিতর্ক কীভাবে দেখছেন?
কবিরুল বাশার: আসলে দীর্ঘদিন যখন কোনো কীটনাশক ব্যবহার হয়, তখন তা কার্যকরতা হারায়। কারণ, তা সহনশীল হয়। নতুন কীটনাশক কাজ দেবে, এটা বিশ্বে মশকনিধনে ব্যবহৃত হয়।
প্রথম আলো: ম্যালাথিয়ন কেনার কথা শুনছি, এটা তো কৃষিতেও ব্যবহৃত হয়। এডিস টার্গেট করা কিছু হয়?
কবিরুল বাশার: না। এডিস টার্গেট করা কোনো ওষুধ তৈরি হয় না। এডিস অন্য মশককুলের চেয়ে দুর্বল। পেটে ডিম এলেই কেবল সে রক্ত খায়। তার ২১ দিনের আয়ুষ্কালে চার থেকে পাঁচজনের রক্ত খেতে ও তাদের মধ্যে ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। এখন কথা হলো, যে ওষুধে কিউলেক্স মরবে, সে ওষুধে এডিস তো মরবেই। তদুপরি বলব, নতুন কীটনাশক কেনার আগে অন্তত তিনটি ল্যাবে পরীক্ষা করে কেনা উচিত। শুধু ম্যালাথিয়ন নয়, আমরা বিশেষজ্ঞ কমিটি চারটি কীটনাশক কেনার কথা বলছি। ম্যালাথিয়ন ৫৭ইসি। ম্যালাথিয়ন ৫% আরএফইউ, ডেল্টামেথ্রিন + পিবিও, পাইরিমিফস— মিথাইল। এর মধ্যে যেটির ব্যবহার সুবিধাজনক, সেটা আনা হবে। ভারত, চীন, জার্মানিতে সবটাই সহজলভ্য।
প্রথম আলো: মুঠোফোনে মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন শনিবার কীটনাশকের অকার্যকরতা প্রসঙ্গে আইসিডিডিআরবির একটা সুপারিশ নিয়ে কথা বলেন। ঠিক কী ঘটেছে?
কবিরুল বাশার: আইসিডিডিআরবি বলেছে, পারমিথ্রিন কাজ করে না। তিনটি এজেন্টের সমন্বয়ে কীটনাশক কাজ করে। নক ডাউন এজেন্ট টেট্রাম্যাথ্রিন, অ্যাকটিভিটিং এজেন্ট প্রালেথ্রিন ও পারমিথ্রিন হলো কিলিং এজেন্ট। অন্য দুটি এজেন্ট কার্যকর থাকলে পারমিথ্রিনের বেশি কার্যকর হওয়ার কথা। তাই তিনটিকে একত্রে পরীক্ষা করার দরকার ছিল, যা করা হয়নি। তাই ব্যবহৃত কীটনাশককে পুরোপুরি অকার্যকর বলা যায় না।
প্রথম আলো: আইসিডিডিআরবি কেন ওই পরীক্ষাটি করল? বাংলাদেশে মশকনিধনে কীটনাশক কাজ করে না, সেটা দেখতেই কি?
কবিরুল বাশার: না। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি, আটলান্টা থেকে একটি প্রডাক্ট হিসেবে পারমিথ্রিন পরীক্ষার অনুরোধ এসেছিল। তাদের ভুলটা হলো, বাংলাদেশে তারা গবেষণার ফলাফলটা প্রকাশ করেছে। বলেছে, সিটি করপোরেশনের ওষুধে কাজ করে না। তাই মেয়র খোকনের ক্ষোভের কারণ বোধগম্য।
প্রথম আলো: আপনি কি আটলান্টা বা আইসিডিডিআরবির ওই পদক্ষেপ নিয়ে মন্তব্য করবেন? শুধুই কাকতাল বলে নাকচ করবেন?
কবিরুল বাশার: নাকচ করব না, মন্তব্যও করব না। আদালতও আদেশ করেছেন কীটনাশক বদলাতে।
প্রথম আলো: আদালতের সিদ্ধান্তে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের যথেষ্ট সন্নিবেশ ঘটেছিল?
কবিরুল বাশার: মন্তব্য করব না। মহামান্য আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে যেকোনো আদেশ দিতে পারেন। তবে এটা বলতে পারি, যে কীটনাশকই আনা হোক না কেন, যদি সঠিক সময়ে ও সঠিক উপায়ে এর প্রয়োগ না ঘটে, তাহলে তা কাজ দেবে না। দুই সিটি করপোরেশনেই এমন একজন লোকও নেই, যিনি কিউলিক্স ও এডিস মশার পার্থক্য করতে পারেন।
প্রথম আলো: এই মুহূর্তের কি করণীয়? ঢাকার যদি অবস্থা এই হয়, তাহলে সারা দেশে কী ঘটবে?
কবিরুল বাশার: এই মুহূর্তে আর এডিস নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে নেই। ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে গেছে। তারা তো জানেই না, এডিস মশা কী। তাই তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। সরকারের উচিত হবে অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে জনগণের কাছে সরাসরি সাহায্য চাওয়া। জনগণ এখনই অংশ না নিলে সরকার একা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। মানুষকে মশা চিনিয়ে বলতে হবে, আপনি এভাবে মশা মারুন। নিজে বাঁচুন, আপনার পরিবারকে বাঁচান। পরিবার বাঁচলে সমাজ বাঁচবে। সমাজ বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। বাড়ির আশপাশ দেখুন, কোথাও কোনো পাত্রে পানি জমে থাকে কি না। যদি থাকে তা ফেলে দিয়ে সেই পাত্রটিকে উল্টে রাখুন। যাতে কোনোভাবেই আপনার বাড়িতে মশা বংশ বিস্তার করতে না পারে। তাই বলি, মানুষই পারবে। সরকার, ইউপি, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন—কেউ পারবে না।
প্রথম আলো: মেয়র খোকন বললেন, পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমাদের জনগণের ধারণার বড় পার্থক্য আছে।
কবিরুল বাশার: আমি জানি না তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সফররত প্রতিনিধি মি. নাগের প্রতি সম্মান রেখেই বলি, গতবার তাঁর সঙ্গে দেখাও হয়েছিল। তাঁরা আমাদের চেয়ে আলাদা কিছু বলতে বা করতে পারেন, তা মনে করি না। ডব্লিউএইচও যা বলছে, তা এক বছর আগে থেকে চিৎকার–চেঁচামেচি করে আমরা বলেছি। সেসবের যদি বাস্তবায়ন হতো, তাহলে নিয়ন্ত্রণে থাকত। ডব্লিউএইচওর পরিকল্পনা ও আমাদের পরিকল্পনা অভিন্ন।
প্রথম আলো: কলকাতার সাফল্যের কারণ?
কবিরুল বাশার: তারা অনেক সুন্দর করে পরিকল্পনা করেছে এবং তা বাস্তবায়নও করেছে।
প্রথম আলো: কলকাতা নাগরিক গাফিলতির জন্য এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে। তৌহিদ সাহেব জানালেন, আপনারা ম্যানিলা, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুরের আদলে একটি আইনের খসড়া করেছিলেন। মেয়র খোকন বললেন, বিশেষ করে নির্মাণাধীন বাড়িতে মোবাইল কোর্ট সক্রিয়। একজন সাত দিনের জেল খাটছেন।
কবিরুল বাশার: নাগরিকদের দায়বদ্ধ করতে আমাদের একটি আইনি হাতিয়ার দরকার।
প্রথম আলো: ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নজরুল ইসলাম আমাদের এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেন, এমবিবিএসের পাঠ্যসূচিতে ডেঙ্গু উপেক্ষিত, চিকিৎসকের সংকটও প্রকট।
কবিরুল বাশার: ডেঙ্গুর রোগ–লক্ষণ দ্রুত নিয়মিতভাবে বদলায়। আগের বারের সঙ্গে পরের বারেরটা মিলবে না। সে জন্য আমরা চিকিৎসকদের জন্য একটি ক্লিনিক্যাল ম্যানুয়াল এবং একটি পকেট গাইডলাইন তৈরি করেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে আছে।
প্রথম আলো: মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সময়ে আপনি সিটি করপোরেশনে চাকরি করতেন। সেটা ছেড়ে আপনি মশা বিষয়ে পিএইচডি করতে জাপান গেলেন। দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র?
কবিরুল বাশার: আছে। ক্যানসার, কৃমি ও মশার ওপর গবেষণার প্রস্তাব এসেছিল। আমি বেছে নিই মশা, বন্ধুরা ঠাট্টা করেছেন। ২০০০ সালে ডেঙ্গু ছড়ালে ড. ইউকিগোর নেতৃত্বে জাইকা অবিভক্ত সিটি করপোরেশনে একটি প্রকল্প নেয়। কীটতত্ত্বের ছাত্র থাকতেই আমি ওই প্রকল্পে চাকরি পাই। প্রকল্পটি অনেক সুফল দিয়েছিল। অথচ সাদেক হোসেন খোকা মেয়র হয়ে এসে প্রথমে আমাদের ১৪ জনের বেতন বন্ধ করেন। এরপর প্রকল্পটিই বন্ধ করেন। দুঃখজনকভাবে সেদিন রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছিল। সারা দেশের স্থানীয় সরকারের অঙ্গসমূহে গবেষকদের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী সংস্থা গড়ে তোলা উচিত। এসব সংস্থা হবে স্বাধীন, তাদের বেতন রাজস্ব খাত থেকে দিলে চলবে না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
কবিরুল বাশার: ধন্যবাদ।