বিশেষ সাক্ষাৎকার: ইমতিয়াজ আহমেদ
আমাদের তরুণেরা এখন কেন আফগানিস্তান যাবে
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেন আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারির অবসান, ক্ষমতার পালাবদল ও দেশটির রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। আলোচনায় আসে বাংলাদেশে এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়াও।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো: আফগানিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল, মার্কিন-সমর্থিত সরকারের পশ্চাদপসরণ ও কাবুলে বিনা বাধায় তালেবানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ: ২০ বছর আগে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সহায়তায় আফগানিস্তানে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা সারা দেশে কখনোই কর্তৃত্ব করতে পারেনি। শহরাঞ্চলে তাদের শাসন সীমিত ছিল। এর বাইরে বিরাট এলাকায় কর্তৃত্ব ছিল তালেবানের। আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার ঘোষণার কয়েক দিনের মাথায় যেভাবে তালেবান কাবুলে ঢুকেছে, তাতে মনে হয় তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল। এর আগে তালেবান একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানী দখল করে নেয়। যে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে সামরিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, তাদের এভাবে পিছু হটা বিস্ময়কর। এখন প্রশ্ন হলো দুই দশকের যুদ্ধে আফগানিস্তানে যে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা গেছে, লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে, এর দায় কে নেবে? আমার মনে হয়, যুদ্ধে জয়ী হওয়া তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও নয়। উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধবাজদের সমরাস্ত্র বিক্রির পথ সুগম করা। আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে তারা একটি দেশ তছনছ করে দিল।
প্রথম আলো: তালেবান কাবুলের কর্তৃত্ব নিলেও এখনো সরকার গঠিত হয়নি। তালেবান মুখপাত্র সবাইকে নিয়ে সরকার গঠনের কথা বলেছেন। প্রস্তাবিত সরকারের রূপরেখা কেমন হবে বলে মনে করেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আমি মনে করি, তালেবান যেভাবে ক্ষমতা দখল করেছে, তাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তাদের হাতেই রাখবে। অন্যদের সঙ্গে সমঝোতা হবে বলে মনে হয় না। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য তালেবান এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবে সবাইকে নিয়ে দেশ চালানো হচ্ছে। যেভাবেই সরকার গঠিত হোক না কেন তালেবানই কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। নিয়ামক শক্তি হবে। তবে আফগানিস্তানের ভেতরে যারা ২০ বছর শাসন করেছে, তারা এই পরাজয় সহজে মানতে না–ও পারে। ফলে বিদ্রোহ দেখা দেওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
প্রথম আলো: তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর কী রকম সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে মনে করেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: এই ঘটনায় রাশিয়া স্বস্তিবোধ করবে। কেননা, তাদের ঘাড়ের ওপর মার্কিন সেনা ছিল। তবে কঠিন সত্য হলো আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া ও আমেরিকা দুই পরাশক্তিকেই চলে যেতে হয়েছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের ৯০ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। তাদের বিআরআই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথ সুগম হলো। তালেবান ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে তারা উইঘুরের মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে নাক গলাবে না। সে ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তালেবানের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে মনে হয়। আমেরিকা চলে যাওয়ায় ইরান খুশি। পাকিস্তানও স্বস্তিবোধ করবে। ২০ বছরে তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। লাখ লাখ শরণার্থীর বোঝা তাদের ওপর চেপেছিল। আফগানিস্তানে ভারতেরও বিশাল বিনিয়োগ আছে। তারা সেই বিনিয়োগ রক্ষা করতে চাইবে। ভারতের কূটনীতিকেরা দক্ষ। তবে তাদের ভুল হলো, আশরাফ গনি সরকারের ওপর বেশি আস্থা রাখা। চীন, ইরান, রাশিয়া, তুরস্ক দূতাবাস রেখে দিয়েছে। সার্কের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশেরও উচিত হবে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলা। আফগানিস্তানের সঙ্গে আমাদের উল্লেখযোগ্য ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। যদিও ব্র্যাক বহু বছর ধরে সেখানে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা প্রসারে কাজ করছে। সবার আগে সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে।
প্রথম আলো: আফগানিস্তানে সরকার গঠিত হয়নি এখনো। কোনো সংঘাতের আশঙ্কা আছে কি না?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আফগানিস্তানে বহু বছর যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত একটি শাসনকাঠামো ছিল। তার অনুপস্থিতিতে যে কেউ অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে যত দ্রুত সরকার গঠিত হয়, ততই ভালো। আফগানিস্তানে এমন সরকার গঠন করতে হবে, যারা দেশটিতে দ্রুত স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পাররে। আমি সেখানে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা দেখছি না।
প্রথম আলো: ২০ বছর আগের তালেবান সরকারের সঙ্গে বর্তমান তালেবানের মধ্যে কোনো ফারাক দেখছেন কি? তালেবান মুখপাত্র ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, নারীর শিক্ষা ও কাজে কোনো বাধা থাকবে না, বাইরের কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেবেন না।
ইমতিয়াজ আহমেদ: ফারাক তো আছেই। তবে মৌলিক চিন্তায় খুব ফারাক থাকবে বলে মনে হয় না। ২০ বছর আগে আফগানিস্তানে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তালেবান বলেছে, তারা করেনি। করেছে আইএস ও আল-কায়েদা। তালেবান বুঝতে পেরেছে, অন্য দেশের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের ক্ষতি করেছে। তাই পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা দেখি না। ২০ বছর আগের তালেবান ছিল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। পাকিস্তান ও সৌদি আরব ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল না। এবার তারা ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সফল কূটনৈতিক আলোচনা করেছে।
প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ যেন কিছুসংখ্যক আফগান শরণার্থীকে সাময়িক আশ্রয় দেয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। আপনার অভিমত কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ: যুক্তরাষ্ট্র কেন এ ধরনের প্রস্তাব দিল আমার বোধগম্য নয়। বাংলাদেশ চার বছর ধরে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহন করছে। সেদিক থেকে বলব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। তবে এখানে যেসব আফগান শিক্ষার্থী আছেন, তাঁদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে বিষয়টি সরকারকে দেখতে হবে।
প্রথম আলো: আফগানিস্তানে ক্ষমতা বদল উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে কী প্রভাব ফেলতে পারে? ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বলেছেন, কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি তরুণ আফগানিস্তানে যাওয়ার পথে ধরা পড়েছেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ: প্রথম কথা হলো ডিএমপি কমিশনার এমন কথা বলতে পারেন কি না। এর পেছনে কী তথ্যপ্রমাণ আছে, তা তিনি দেখাননি। ডিএমপির দায়িত্ব দেশের ভেতরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখা। তাঁর এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, যা দেশের ভাবমূর্তির জন্য ইতিবাচক নয়। অনেক শক্তি ওত পেতে আছে বাংলাদেশকে মৌলবাদী জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করার জন্য। আমাদের এমন কিছু বলা উচিত নয়, যা দেশের সুনাম নষ্ট করে। মনে রাখতে হবে ২০ বছর আগের ও পরের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০ বছর আগে আফগানিস্তান বিদেশি বাহিনীর দখলে ছিল। সেই দখলদারি থেকে উদ্ধারের জন্য তারা বাইরের সহায়তা চেয়েছিল। এখন তো আফগানিস্তানে কোনো বিদেশি বাহিনী নেই। তালেবান কারও সহায়তা চায়নি। তাহলে বাংলাদেশ থেকে তরুণেরা সেখানে কেন যাবেন?
প্রথম আলো: আফগানফেরত জঙ্গিরা বাংলাদেশে ফিরে এসে জঙ্গি সংগঠন করেছে। বোমা-গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। এখনো সে রকম কোনো আশঙ্কা দেখছেন কি না?
ইমতিয়াজ আহমেদ: মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে এ ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি হতে পারে না। ২০ বছর আগে যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জঙ্গিদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিয়েছেন। রাজনৈতিক স্বার্থেও তাদের ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এখন বাংলাদেশে যে সরকার আছে, তাদের বিরুদ্ধে এ রকম কোনো অভিযোগ নেই। বরং হোলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ডের পর সরকার জঙ্গিদের বিষয়ে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখিয়ে আসছে। জঙ্গিদের বিচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতেও কাজ করেছে। তাই আমি মনে করি না, আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরাগমনে আমাদের আতঙ্কের কারণ আছে। তবে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। জেনে হোক, না জেনে হোক আগে যাঁরা জঙ্গিদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন, তাঁদেরও এই গোষ্ঠী থেকে দূরে থাকা উচিত।
প্রথম আলো: আফগানিস্তান সার্কের অন্যতম সদস্য। সার্ক সচল থাকলে আফগানিস্তানে এই ক্ষমতার পালাবদলে আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগ বাড়ত কি না?
ইমতিয়াজ আহমেদ: অবশ্যই বাড়ত। সার্কের গঠনতন্ত্রে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ নিয়ে আলোচনা হয় না। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সমস্যার বাইরেও অনেক সমস্যা আছে, যা সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা যেত। কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিরোধেও সার্ক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত। করোনার শুরুতে ভারত এ রকম একটি উদ্যোগও নিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই দিল্লি সার্ককে অকেজো করে রেখেছে। এতে ভারতেরই বেশি ক্ষতি হয়েছে। টিকার ভূরাজনীতিতে চীন অনেক এগিয়ে গেছে। আমার ধারণা, ভারতে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলে সার্ক এ রকম অকার্যকর হয়ে থাকত না। সার্ক অচল হয়ে থাকায় এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব আরও বেড়েছে। সার্ককে এভাবে জীবন্মৃত অবস্থায় না রেখে সচল ও সজীব করা সময়ের দাবি বলে মনে করি।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
ইমতিয়াজ আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।