দুই বিদেশি হত্যায় দেশে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে জঙ্গিদের যোগসূত্র থাকার বিষয়টি সামনে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশিদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো
প্রথম আলো: দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পরই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। সরকার বলছে, এই হত্যাকাণ্ডে বিএনপি-জামায়াতের হাত আছে। বিএনপি বলছে, জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর চেষ্টা।
হারুন-অর-রশিদ: এ অভিযোগ নতুন নয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই অংশ। তবে প্রধানমন্ত্রী যে দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্জন। যারা এই অর্জনকে ভালোভাবে নেয়নি, তাদের দ্বারা এ কাজ হতে পারে। দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যা করে তারা দেখাতে চেয়েছে যে বাংলাদেশ বিদেশিদের জন্য নিরাপদ নয়। এ ছাড়া দুজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। গত কয়েক মাস দেশের অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। সেটি নষ্ট করাও এর উদ্দেশ্য হতে পারে। হত্যার পেছনে দুটি বিষয়ই পটভূমি হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে আমি মনে করি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার তদন্তের মাধ্যমেই প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।
প্রথম আলো: কিন্তু তদন্তের আগেই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের হাত থাকতে পারে।
হারুন-অর-রশিদ: এটি তাঁর ধারণা। আর এই ধারণার পেছনে রয়েছে বছরের শুরুতে আন্দোলনের নামে দল দুটির পেট্রলবোমা মেরে বহু মানুষ হত্যার ঘটনা।
প্রথম আলো: বিএনপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তদন্তের দরকার হবে না। সরকার যাদের চাইবে, তাদেরই সাজা দেবে।
হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি তাদের ধারণার কথা বলেছে। যদিও এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে পারেনি। রাজনীতিতে যদি কোনো পক্ষ খেলার নিয়ম না মেনে চলে, তাহলে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনীতি আশা করা যায় না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মতাদর্শগতভাবে পরাস্ত করা আর শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা নিশ্চয়ই এক নয়। আমরা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় সেটাই দেখেছি। এর আগেও যতগুলো বোমা-গ্রেনেড হামলা হয়েছে, তারও লক্ষ্যবস্তু ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।
প্রথম আলো: সরকার এত দিন বলেছিল, জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে নির্মূল হয়নি।
হারুন-অর-রশিদ: জঙ্গিবাদ কেবল জাতীয় বা আঞ্চলিক সমস্যা নয়। আন্তর্জাতিক সমস্যা। যেসব দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, সেসব দেশেও তো জঙ্গি হামলা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী তৎপরতাকে দেখতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইও নিরন্তর প্রক্রিয়া। অতীতে বাংলাদেশে জঙ্গিরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছে; এখন সেটি পাচ্ছে না। জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে সরকার অভিযান চালাচ্ছে। অনেকে ধরাও পড়েছে।
প্রথম আলো: কিন্তু তাদের বিচার হচ্ছে কি?
হারুন-অর-রশিদ: বর্তমান সরকারের আমলে অনেক জঙ্গির বিচার হয়েছে। শাস্তি পেয়েছে। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও চলছে।
প্রথম আলো: নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে গার্ডিয়ান-এ সাক্ষাৎকার দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে জঙ্গিবাদের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশই সতর্ক নয়।
হারুন-অর-রশিদ: দেখুন, ১৬ কোটি মানুষের দেশ। কোনো অপশক্তি যদি টার্গেট করে কারও ওপর আঘাত করে, সেটি বন্ধ করা কঠিন। তার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে। জঙ্গিদের ব্যাপারে বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণেই সেটি হবে না।
প্রথম আলো: এত দিন সরকারি দলের নেতারা-মন্ত্রীরা বলেছেন, বাংলাদেশে আইএস আছে। এখন বলছেন, আইএস নেই। কোনটি সত্য?
হারুন-অর-রশিদ: আইএস আছে—সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে এ রকম কিছু বলা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম প্রভৃতি সংগঠনের সদস্যরা বলেছে, তারা আইএসের হয়ে কাজ করছে। আইএসের কোনো শাখা বাংলাদেশে কাজ করছে, এমন প্রমাণ নেই। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার কথা বলেছেন।
প্রথম আলো: তাহলে আইএস নেই?
হারুন-অর-রশিদ: আইএস নেই। জঙ্গি আছে। তবে বাংলাদেশের সমাজে কখনোই তারা ঘাঁটি গাড়তে পারবে না। মানুষের সমর্থন পাবে না। যেকোনো দেশে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হলে ভিত্তি ও আশ্রয় লাগে, সেটি এখানে তারা পাবে না।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী আছে, তারা কি দেশীয় কাঠামোয় কাজ করে, না আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে?
হারুন-অর-রশিদ: আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে উঠেছিল, তাতে বাংলাদেশ থেকে অনেকে গিয়েছিল, তারা দেশে ফিরে হরকাতুল জিহাদ, জেএমবিসহ বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের সঙ্গে তাদের শক্ত নেটওয়ার্ক আছে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: জঙ্গিবাদী সমস্যাটি কি নিছক আইনশৃঙ্খলাজনিত, না রাজনৈতিক?
হারুন-অর-রশিদ: রাজনৈতিক সমস্যা তো বটেই। তবে সেই সমস্যার মূলে হলো একাত্তর ও পঁচাত্তর। একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তাদের সঙ্গে আজকের জঙ্গিদের গভীর যোগসূত্র আছে বলে মনে করি।
প্রথম আলো: অনেকে বলেন, বর্তমান সংকটের মূলে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন।
হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচন তো জনগণের জন্য। জনগণ এটি মেনে নিয়েছে। বরং আমি বলব, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না এসে বিএনপি বড় ভুল করেছে। মানুষ আর গৎবাঁধা রাজনীতি পছন্দ করছে না। বিএনপি-জামায়াত পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ হত্যা না করলে হয়তো মানুষ তাদের পক্ষে থাকত। ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিএনপি নিজেকেই প্রান্তিক করে ফেলেছে। তারা এখন জনগণ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন।
প্রথম আলো: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গে ব্রাকেটবন্দী করা ঠিক হবে না। দুই দলের রাজনীতি ভিন্ন। এই বক্তব্যে কি ইতিবাচক কিছু দেখেন?
হারুন-অর-রশিদ: আমরা তো বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামী থেকে বিযুক্ত অবস্থায় দেখতে চাই। কিন্তু তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই সূচিত হয়েছে, যা প্রায় অবিচ্ছিন্ন। দল দুটি একই রাজনৈতিক ধারাকে ধারণ করে। বিএনপির তরুণ নেতৃত্ব আরও বেশি হতাশ করেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে তাদের অবস্থানটি দেখুন। বিএনপি যুদ্ধাপরাধী নিজামী-মুজাহিদকে মন্ত্রী করেছে।
প্রথম আলো: কিন্তু আওয়ামী লীগও তো জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করেছিল?
হারুন-অর-রশিদ: একটি হলো আত্মিক সম্পর্ক; আরেকটি কৌশলগত। বিএনপি জামায়াতের মধ্যে যে যতই বিচ্ছেদ ঘটাতে চান না কেন, তা হবে না।
প্রথম আলো: বিএনপির নীতি ও আদর্শ থেকে সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির কোনো ফারাক আছে কি?
হারুন-অর-রশিদ: বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ বা জাতীয় পার্টি কোনো শক্তিই নয়। এটি একটি আঞ্চলিক দল। ভবিষ্যতেও এর সম্ভাবনা নেই।
প্রথম আলো: গণতন্ত্রে বিরোধী দল বা পক্ষের মতপ্রকাশের অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু বর্তমানে তারা সেই অধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না।
হারুন-অর-রশিদ: আমরা তো দেখলাম, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের নামে বিএনপি-জামায়াত পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করল। কোনো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ এসব মেনে নেবে না। নির্বাচন বা আন্দোলন উভয় ক্ষেত্রে একটি ধারাবাহিক নীতি থাকতে হয়। বিএনপি সেটি রক্ষা করতে পারেনি। তারা পাঁচ সিটি নির্বাচনে জয়ী হলো, এরপর জাতীয় নির্বাচন বর্জন করল, আবার তিন সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েও মাঝপথে সরে দাঁড়াল। বিএনপিতে দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। সরকার বিএনপির প্রতি কী রকম আচরণ করে, তার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। জনগণের কাছে যেতে হবে।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৈরিতা চলতে থাকলে কি জঙ্গিগোষ্ঠী আরও ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হবে না?
হারুন-অর-রশিদ: বাংলাদেশের মানুষ কখনোই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেবে না। জঙ্গিবাদ প্রসারের সামাজিক পূর্বশর্ত এখানে নেই। তাই, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৈরিতার সুযোগেও তাদের শক্তি বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখি না। তবে আমি মনে করি, একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সবার অংশগ্রহণ থাকা জরুরি। তবে সেটি হতে হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে। অতীতের ভুল সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে বিএনপি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রথম আলো: এই যে দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যা করা হলো। এটা কি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়?
হারুন-অর-রশিদ: আমি তা মনে করি না। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত কারণেও হামলা হতে পারে। তবে এ জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার কিংবা এটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ভাবার কোনো কারণ নেই।
প্রথম আলো: আমাদের নাগরিক সমাজ কেন গণতন্ত্রের সুরক্ষা ও বিকাশে ভূমিকা নিতে পারছে না?
হারুন-অর-রশিদ: এটিও সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশের যে স্তরে আমরা আছি, তার প্রতিফলন। রাষ্ট্রযন্ত্র ও জনগণের মাঝখানে সংঘবদ্ধ সচেতন জনগোষ্ঠী হলো নাগরিক সমাজ; যার ভিত্তি হবে সংবিধান, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার। সেগুলো তারা তুলে ধরবে। কিন্তু আমাদের নাগরিক সমাজ হয় আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির পক্ষে কথা বলে। স্বতন্ত্র ভূমিকা নিতে পারে না। রাজনৈতিক সমীকরণটাই এখানে বড়। আরেকটি বিষয় হলো, রাজনৈতিক সংযোগ ছাড়া কোথাও প্রবেশাধিকার পাওয়া যায় না।
হারুন–অর–রশিদ: উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।