অন্যের মতকে সহ্য করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে: জামিলুর রেজা চৌধুরী

>
জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী (১৯৪৩-২০২০)। একজন পরিচ্ছন্ন মেধাবী মানুষ। সব অর্থেই যিনি অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। তিনি এক সাক্ষাৎকারে তাঁর নিজের কথা যেমন বলেছিলেন, তেমনি বলেছিলেন দেশের এগিয়ে যাওয়া, সমস্যা-সম্ভাবনা এবং তাঁর আশাবাদের কথা। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন মনজুরুল আহসান বুলবুল। ২০১৪ সালের ১৪ মার্চ বৈশাখী টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এই সাক্ষাৎকারটির লিখিতভাষ্য প্রথম আলো অনলাইনের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

মনজুরুল আহসান বুলবুল: শুরু হোক আপনার নিজের কথা দিয়েই। আপনার জামিলুর রেজা চৌধুরী হয়ে ওঠার গল্প শুনি।

জামিলুর রেজা চৌধুরী: ছোটবেলা থেকেই একটা প্রকৌশলী পরিবেষ্টিত পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। পরিবারে শুধু বাবা না, আরও কয়েকজন প্রকৌশলী ছিলেন। যখন আমার জ্ঞান হয়নি, তখন থেকেই আমার ম্যাগাজিন পড়া শুরু নাড়াচাড়ার মধ্য দিয়েই। পড়তে পারতাম না, কিন্তু পাতা ওলটাতাম, ছবি দেখতাম।

মনজুরুল আহসান: ছোটবেলায় কী হবেন বলে স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভবিষ্যতের সঙ্গে তা কি মিলল?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: অনেকের তো চিন্তা করতে হয় ভবিষ্যতে কী পড়ব, কী পেশা নেব। আমার সেই রকম চিন্তা করতে হয়নি। বিজ্ঞান পড়ব, এটা সিদ্ধান্তই ছিল। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে প্রকৌশল বিষয় নিয়ে পড়ব, এটাও একরকম সিদ্ধান্তই ছিল এবং হলোও তা–ই । সে মতোই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলাম।

মনজুরুল আহসান: পেশা নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: শিক্ষকতাই করব, এমনটি নিশ্চিত পরিকল্পনা ছিল না। তবে ফোর্থ ইয়ারে পড়ার সময় থিসিস করতে গিয়ে এ বিষয়ে আমি আগ্রহী হলাম। আমার যে হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট ছিলেন, তিনিও আমাকে উৎসাহিত করলেন। আর সে সময় পরীক্ষায় যারা ভালো করতে, ফার্স্ট, সেকেন্ড বা থার্ড হতো তাদের শিক্ষকতায় আসার একটা রেওয়াজ ছিল। যদিও সে সময় শিক্ষকতার প্রারম্ভিক বেতনের চাইতে বাইরে প্রায় তিন গুণ বেশি বেতন পাওয়া যেত। তবে আমার শিক্ষকতা জীবনের শুরুর বিষয়টিও বেশ মজার। শুরু হলো কোনো ইন্টারভিউ ছাড়াই। যেদিন আমার ফাইনাল পরীক্ষার ফল বের হলো, আমি দেখা করতে গেছি আমার বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে। তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, এখন কথা বলার সময় নেই। তোমার ফল তো ভালো, তুমি থার্ড ইয়ারে ক্লাস নেওয়া শুরু করে দাও। একজন শিক্ষক অনুপস্থিত, তাঁর জায়গায় তুমি পড়ানো শুরু করো। আমার তো কোনো প্রস্তুতি নেই। ক্লাসে গিয়ে দেখি, ছাত্রদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা আমারই সহপাঠী, কোনো কারণে হয়তো ইয়ার লস করেছে, তারাও আমার ছাত্র হয়ে গেল।

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

মনজুরুল আহসান: ছাত্রজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন? মানে পড়াশোনা ছাড়াও আর কিছু করতেন কি না।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমরা তখন ময়মনসিংহে থাকি। স্কুলে পড়ি। হঠাৎ মনে হলো আমরা একট ক্লাব করব। তখন টিনের টুকরায় 'ইস্ট বেঙ্গল বয়েজ ক্লাব' নামে একটি সাইনবোর্ড লিখে আমাদের গ্যারেজের ওপর টানিয়ে দিলাম। খেলাধুলার জন্যই এই আয়োজন। তবে বড় সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হলাম ১৯৫৩ সালে। আমরা ঢাকায় এলাম ১৯৫২ সালে। গোপীবাগে থাকি। তখন গোপীবাগে ব্রাদার্স ইউনিয়ন বলে একটি ক্লাব চালাতেন পরে খ্যাতনামা সাংবাদিক এবিএম মূসা, আমাদের মূসা ভাই। তাঁর সঙ্গে ভিড়ে গেলাম। ক্লাবটি মূলত খেলাধুলার হলেও একটি বড় লাইব্রেরি ছিল। নানা সাংস্কৃতিক তৎপরতাও ছিল। বার্ষিক নাটক হতো। সব মিলিয়ে আমি এই ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। কিন্তু যে নাটকটির জন্য আমি দীর্ঘদিন রিহার্সেল দিলাম 'স্পেন বিজয়ী মুসা', সেটি আর মঞ্চস্থ হয়নি।

মনজুরুল আহসান: শিক্ষকতার একপর্যায়ে আপনি বাইরে গেলেন, ফিরলেন নতুন এক স্বপ্ন নিয়ে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমার সৌভাগ্য যে বিভিন্ন সময়ে আমার নানা সুযোগ এসেছে। আমি তো পেশায় পুরকৌশলী, আমার মূল পড়াশোনার বিষয়ও তা–ই। ২৫ বছর বয়সে আমি পিএইচডি শেষ করি। দেশে ফিরে আবার শিক্ষকতাই শুরু কলরাম। কিন্তু ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন ভার্সিটিতে পিএইচডি করতে গিয়ে আমি একটু পথ বদলালাম। আমার মূল বিষয় স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিয়ারিং থেকে কম্পিউটারের দিকে ঝুঁকলাম। আমি পিএইচডির জন্য কাজ করেছি ১৯৬৬, '৬৭, '৬৮ সালে। তখন কেবল কম্পিউটারের যাত্রা শুরু। মেইন ফ্রেম, কঠিন প্রোগ্রামিং। আমি সুযোগটি হাতছাড়া করলাম না। আয়ত্ত করলাম। আমি তখনই ধারণা করতে পারলাম, ভবিষ্যৎ হলো কম্পিউটারে। এটা শুধু বিজ্ঞানপ্রযুক্তি নয়, দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠবে, এটাই আমার ধারণা ছিল। আমার পিএইচডি থিসিসে এর একটি চ্যাপ্টার আছে।

মনজুরুল আহসান: তখন এ দেশে কম্পিউটারের কী অবস্থা?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: ঢাকায় এ অঞ্চলের প্রথম কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে। এটি ছিল অ্যাটমিক এনার্জি সেন্টারে। আইবিএম-১৬২০। তখনকার দিনে খুবই উন্নতমানের। আমি পিএইচডি করে দেশে ফিরে দেখি, আমাদের ওই একটাই কম্পিউটার, কাজ ও গবেষণার জন্য।

মনজুরুল আহসান: বুয়েটে কম্পিউটার ঢুকলে আপনার হাত ধরেই।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: অনেকটা সে রকমই। বুয়েটে তখন কম্পিউটার পড়ানো হতো না। আমি আমার শিক্ষক ও সহকর্মীদের বোঝাতে সক্ষম হলাম। আমি নিজেই একটা সিলেবাস তৈরি করে কম্পিউটার বিষয়টি পড়ানো শুরু করলাম। দেশে এই প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামিং পড়ানো শুরু হলো। কিন্তু তখনো বুয়েটে কোনো কম্পিউটার নেই। সে সময় একটি ভালো কম্পিউটারের দাম পড়ত এক কোটি টাকা। তখন বুয়েটে আমরা সবাই একমত হলাম, সব বিভাগের এক বছরের ইকুইপমেন্ট খাতে উন্নয়ন বাজেটের টাকা দিয়ে একটা কম্পিউটার কেনা হবে, হলোও তা–ই । এভাবেই বুয়েটে প্রথম কম্পিউটার এল।

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

মনজুরুল আহসান: আপনারও দায়িত্ব বাড়ল।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: তখন কেবল কাজ বাড়ল। আমি যখন বিভাগে যোগ দিই, তখন আমিই সবচেয়ে নবীন। আমার সিনিয়র এত জন ছিলেন যে আমি যে ২০–৩০ বছরে বিভাগীয় প্রধান হতে পারব, তা কল্পনাও করতে পারতাম না। ১৯৭৪-৭৫ সালে আমি ইংল্যান্ডে গেলাম ভিজিটিং প্রফেসরের একটি ফেলোশিপ নিয়ে। ফিরে এসে দেখি, বিভাগ প্রায় খালি। আমার সিনিয়র যাঁরা, তাঁরা প্রায় সবাই উচ্চ বেতন ও পদবি নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। সৌদি আরব, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এসব দেশে। তখন বিভাগে আমি সিনিয়রিটিতে দুই নম্বর হয়ে গেছি। আমার সিনিয়র যিনি, তিনিও প্ল্যানিং কমিশনের মেম্বার হয়ে চলে গেলেন। এভাবেই বিভাগীয় প্রধান হওয়ার দায়িত্ব পেলাম। তখন বুয়েটের সবচেয়ে বড় বিভাগ এটি, প্রায় এক হাজার ছাত্রছাত্রী। আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। বিভাগে আমিই একমাত্র পিএইচডি, ১০–১২ জন শিক্ষক। আজ বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর অন্যতম বড় বিভাগ এটি। এক বিভাগেই পিএইচডি আছেন ৫০ জনের বেশি।

মনজুরুল আহসান: শিক্ষকতার বাইরে আপনি দেশের নানাবিধ অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তখন থেকেই।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: এ দেশের গত কয়েক দশকের অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রায় অধিকাংশগুলোতেই আমার সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ হয়েছে। আমার স্পেশালাইজেশন ছিল উঁচু ইমারত তৈরি। সত্তরের দশক থেকে ঢাকায় উঁচু ইমারত তৈরির প্রবণতা শুরু হয়। অনেকে তখন এ বিষয়ে বুয়েটে আসতেন পরামর্শের জন্য। আমি এবং আমার সহকর্মীরা উৎসাহ নিয়েই এ কাজগুলো করতাম। সেই থেকে শুরু। দেখুন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকা রাস্তা ছিল ছয়–সাত শ কিলোমিটার। আবার এর ৮০ ভাগ ছিল সিলেটে। ঢাকায় তেমন পাকা রাস্তা ছিল না। শহরের একটু বাইরে গেলেই কাঁচা রাস্তা। এখন সেখানে দুই লাখ কিলোমিটারের বেশি পাকা রাস্তা হয়েছে। ১৯৭২ সালের পরেও যদি দেখেন, আমাদের বড় কোনো সেতু ছিল না, সব ছিল ফেরিনির্ভর। এখন আমাদের প্রায় সব বড় নদীতেই সেতু হয়েছে। একটাই বাকি আছে, সেটা হচ্ছে পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে আমাদের ন্যাশনাল হাইওয়ে নেটওয়ার্কে আমরা কোনো ফেরি ছাড়াই চলতে পারব।

মনজুরুল আহসান: এই যে অগ্রগতির ধারা, তা কি সঠিক পথে বা সঠিক গতিতেই এগিয়ে চলছে, আপনার কি মনে হয়।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমার ধারণা, গতি আরও বাড়ালে ভালো হতো। বিশ্ব সূচকে আমাদের অবকাঠামোগত সূচক ভালো না।

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

মনজুরুল আহসান: সমস্যা কোথায়, কেন গতি বাড়ানো যায় না?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: অবকাঠামোতে ধীরগতির কারণ রাজনীতিক বা সরকারের মনোভাব। যে–ই সরকারই আসে সব কৃতিত্ব একাই নিতে চায়। বড় অবকাঠামো এক সরকারের আমলে শেষ করার মতো প্রকল্প না। আপনি যদি বঙ্গবন্ধু সেতুর কথাই ধরেন, এর প্রথম সমীক্ষা হয় ১৯৬৯ সালে। পরে জাপানিরা আসে, কাজ চলে '৭২ থেকে '৭৫ পর্যন্ত। তারপরে ১৯৮৫ সালে হলো ফিজিবিলিটি স্টাডি। ১৯৯৩ সালে কাজ শুরু হলো, শেষ হলো ১৯৮০ সালে। কতগুলো সরকার। কিন্তু যাদের আমলে ফিতা কাটা হয়, তারাই সব কৃতিত্ব নিতে চায়। অবকাঠামোগত উন্নয়নে এই দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক না। আপনি যদি দেখেন, পদ্মা সেতুর ফিজিবিলিটি হয়েছে ১৯৯৮ সালে, পরে আবার জাপানিরা এল। নানা ঘটনাপ্রবাহের পর শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হলো এই সরকারের সময়ে।

মনজুরুল আহসান: দুর্নীতিও কি এ ধরনের কাজ এগিয়ে নিতে বড় বাধা?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমি যে প্রকল্পগুলোর সঙ্গে আছি তার মধ্যে যদি যমুনা সেতুর কথাই বলেন, পদ্মা সেতুর আগে এটিই আমাদের সবচাইতে বড় প্রকল্প। বিশ্বব্যাংক বলেছিল যমুনা সেতু হবে না। এই সেতু টিকবে না। নদী শাসন করা সম্ভব না। তারপরও আমরা তো সেটি সঠিকভাবেই শেষ করেছি। বাড়তি ব্যয় খুব বেশি হয়নি। এ কাজে দুর্নীতি হয়নি। ২০০১ সালে ক্ষমতা বদলের পর নতুন সরকার কমিটি করেছিল এই সেতুতে আগের সরকার কী দুর্নীতি করেছে, তা বের করার জন্য । তারা (বিএনপি–জামায়াত জোট সরকার) দুটি দুর্নীতি খুঁজে পেয়েছিল। একটা হলো সেতু উদ্বোধনের সময় বড় দুটি সাইনবোর্ড করা হয়েছিল টেন্ডার ছাড়া। আর বিভাগীয় শহরে যে ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন হয়েছিল, এককভাবে এটার কাজ দেওয়া হয়েছিল একজন নামকরা ফটোগ্রাফারকে। এ ছাড়া এই যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের কাজ, তাতে কোনো দুর্নীতি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মনজুরুল আহসান: কিন্তু পদ্মা সেতু নিয়ে এই যে এত তুলকালাম হলো? আপনি তো এর পাঁচ সদস্যের আন্তর্জাতিক পরামর্শক দলের সদস্য। একটু বলবেন, আসলে পদ্মা সেতু নিয়ে কী হয়েছিল।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: সমস্যা হলো, অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তা, কখনো মিডিয়া বিষয়গুলো গুলিয়ে ফেলে। এ ধরনের প্রকল্পে একটি থাকে উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান, যারা ডিজাইন করবে এবং কাজের তদারকি করবে। আরেকটি হলো ঠিকাদার। দুটো প্রক্রিয়াতেই অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান জড়িত হয়। চূড়ান্ত তালিকাভুক্তির আগে সবাইকেই প্রি–কোয়ালিফাই করতে হয়। এ পর্যায়ে চলে নানা ধরনের লবিং। শুধু আমাদের এখানে নয়, বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরেও লবিং হয়। এটি কাজ পাওয়ার আগের বিষয়। প্রি–কোয়ালিফিকেশন লেভেলে নাম ঢোকাতে হবে সে জন্যই এই লবিং। অনেক প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা নেই কিন্তু তাদের পক্ষে তাদের দেশের অ্যাম্বাসেডররা তদবির করেন। ওয়াশিংটনে তাদের লোকজন আছে, তারাও মাঠে নামে। তারা অনেক সময় ভুল তথ্যও দেয়। কমিটিতে আমরা এমন বেশ কিছু ধরেছি। বলেছি, তোমরা যে বলছ তোমরা এই কাজ করেছ, কিন্তু আমাদের কাছে তথ্য আছে, ওই প্রকল্পে তোমাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সেটি করেছে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের আবার স্থানীয় লবিস্ট আছেন, যাঁ×রা সরকার বা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে এসব কাজ করে বেড়ান। আমাদের সিদ্ধা‌ন্তে তাঁদের কেউ কেউ নাখোশ হয়েছেন। একজন তো বলেই গেছেন, আমার প্রতিষ্ঠানের নাম ঢোকানো হলো না। এই প্রকল্প কীভাবে হয় আমি দেখে নেব। সেই ভদ্রলোক বাংলাদেশি। তিনি এখন আর দেশে নেই। সরকার তাঁকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিল। যেটা নিয়ে প্রকল্পটা বিলম্বিত হলো, তা হলো পুরো প্রকল্পের মধ্যে ছোট একটি প্যাকেজ। ৩ বিলিয়ন ডলারের। যারা তদারকি করবে, কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট নিয়োগ। একটা শর্টলিস্ট করা হলো। কনসোর্টিয়ামের মতো। কোনো একক প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত হলো। এদের একেকটি গ্রুপে নানা ধরনের কাজ করবে। কেউ ব্রিজের বিশেষজ্ঞ, কেউ নদী শাসন বিশেষজ্ঞ, কেউ সংযোগ সড়ক করবে। প্রায় ২০০ ইঞ্জিনিয়ার চার বছর ধরে এ কাজ করবে। এর চূড়ান্ত টেকনিক্যাল ইভালুশন রিপোর্ট পাঠানা হলো। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা বলল, সব ঠিক আছে। কিন্তু গন্ডগোল লাগলে যখন ফিন্যান্সিয়াল অফার খোলা হলো তখন। সবাই আশা করেছে তারাই প্রথম হবে। কিন্তু দেখা গেল কানাডিয়ান ও ব্রিটিশ, তারা এক নম্বর হয়ে গেছে। প্রথমে এক নম্বর হয়েছিল ব্রিটিশ, কিন্তু তাদের একটি দুর্বলতা ছিল। এই অফারের মধ্যে থাকতে হয়, ধরা যাক, প্রকল্প চলাকালে চার শ বার ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা বিমানে যাতায়াত করবে তার হিসাব। তারা এই বিমানভাড়া খুব কম দেখিয়েছে। ফলে অঙ্কের হিসাবে তারা লোয়েস্ট হয়ে যায়। আমাদের কমিটির সব সদস্যই বললেন এটা তো অ্যাবনরমালি লো (অস্বাভাবিক কম)। তারা আবার ফুটনোটে বলেছে, বিল করার সময় আসল ভাড়াই বিল করা হবে। কিন্তু তাদের দাবি ইভালুশন করতে হবে কম ভাড়ার হিসাব ধরে। আমরা বাকি চারটার গড় করে দেখলাম তারা আর এক নম্বরে থাকছে না। খুব ন্যারো মার্জিনে পিছিয়ে যায়। এরা আর যারা আগেই বাদ পড়েছে, তারা একসঙ্গে মাঠে নেমেছিল যে, ঠিক আছে আমাদের যখন কাজ দিল না, দেখি ওরা কীভাবে প্রকল্প করে। কানাডার কোম্পানি এস এ সি লাভালিন যখন নিজের দোষ স্বীকার করেছে, তার মানে কোথাও কিছু একটা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক প্রজেক্ট থেকে দে হ্যাভ বিন ব্ল্যাকলিস্টেড। তারা কিন্তু চ্যালেঞ্জও করেনি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ও আচরণ যৌক্তিক হয়নি। একটা পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক তো প্রেশার ক্রিয়েট করেছে। সরকারকে বলেছে অমুককে বদলাও, এই চেঞ্জ করো। তারা ধারণা থেকেই অনেক কিছু করেছে প্রমাণ ছাড়াই।

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

মনজুরুল আহসান: এখন তো আমরা নিজেরাই পদ্মা সেতু করছি।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: এটা বাস্তবিকভাবে সম্ভব। আমাদের ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। রেমিট্যান্স উৎসাহব্যঞ্জক, রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য। বিদেশি ঠিকাদারদের মধ্যে আস্থার যে অভাব ছিল, সেটা কেটে গেছে।

মনজুরুল আহসান: আপনার হাত ধরেই দেশে প্রথম কম্পিউটার এল। এখন আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: এই খাতে দেশ এগোচ্ছে স্বীকার করি। আমরা অনেক কিছু শুরু করি আগে কিন্তু ধরে রাখতে পারি না। আমাদের নানা ধরনের সংকটের মধ্য দিয়েই এগোতে হয়। আছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। সাময়িক সংকট মেটাতে গিয়ে আমরা অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে পারি না। ২০০৮ সালে যে কমিটি তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা তৈরি করল, আমি তার আহ্বায়ক ছিলাম। আমরা ৩০৫টি সুপারিশ দিয়েছিলাম, তা নিয়েই কাজ শুরু হয়। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি জানা লোকজন আছেন কিন্তু আমাদের সরকারের প্রবণতা হচ্ছে, সবকিছু জেনারেলিস্টদের দিয়ে চালানো। সঠিক জায়গায় সব সময় সঠিক লোককে দায়িত্ব দেওয়া হয় না।

মনজুরুল আহসান: আপনি তো অল্পদিনের জন্য হলেও সরকারে ছিলেন। কেন এমন হয়, কোনো অভিজ্ঞতা।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমি তো সরকারে ছিলাম মাত্র ৮২ দিন। আমাদের দায়িত্ব ছিল মূলত নির্বাচন। সাংবিধানিকভাবে বলা হয়েছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমরা নির্বাচনের কাজের বাইরে যাব না। ৮২ দিনে আমার যা অভিজ্ঞতা, বুঝতে পারলাম, কেউ যখন একবার মন্ত্রী হন বা ক্ষমতায় যান কেন তাঁরা তা ছাড়তে চান না। চেয়ারে বসার পর চারদিক থেকে এত লোক ঘিরে ধরে, বিশেষত তোষামোদী, মোসাহেবি। আপনার কান ভারী করা হবে এই বলে যে, আপনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আপনি যা বলবেন আমি তাই করে নিয়ে আসব। আমাকেও বলা হয়েছিল, যদিও আমি জানতাম কাজটা বেআইনি। আমাদের যাঁরা আমলা, আমি বলব তাঁরাও আংশিক দায়ী, ফর নট গিভিং দ্য প্রপার অ্যাডভাইস। একদিকে রাজনীতিকদের তো এলাকার লোক, ভোটারদের সন্তুষ্টি বিধানের বিষয়। আরেকটা বিষয়, আমি নির্বাচন করলাম এত খরচ করে, তা রিকভার করা এবং পরেরবার নির্বাচন করলে খরচ বাড়বে এই হিসাব–নিকাশ তো থাকেই।

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

মনজুরুল আহসান: সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কোনো সমস্যা?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: মোটা দাগে বলতে গেলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কিছুটা সমস্যা হয়তো হয়েছে। আগে নীতিনির্ধারণী বা বাস্তবায়নের পর্যায়ে মেধাবীরাই থাকতেন। সরকারি চাকরি এখন মেধাবীদের আকর্ষণ করে না। এখনকার তরুণদের আগ্রহ প্রাইভেট সেক্টরের প্রতি, করপোরেট ওয়ার্ল্ড বা এনজিও সেক্টরের প্রতি। অথবা নিজে কিছু করার দিকে ঝোঁক বেশি। বড় পদগুলোতে ইন্টারভিউ নিয়ে মেধাবীদের সরাসরি এন্ট্রি একটি বিকল্প হতে পারে। প্রাইভেট সেক্টরে মাঝারি লেভেলে যে ভালো করছে তাকে সরকারে নিয়ে আসা যায়। পাকিস্তানে তো একবার প্রাইভেট সেক্টর থেকে সচিব পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। আমাদের গোটা সরকারি ব্যবস্থাই তো ফাইলনির্ভর, নোটনির্ভর। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে অনেক সরকারি কর্মকর্তা রাজনৈতিক কারণে ভিকটিমাইজ হন। এমন অনেক অফিসার যার সততার সুনাম ছিল তাঁরাও বিপদে পড়েছেন। আগের সরকারের রাজনীতিকদের ধরতে গিয়ে সেই আমলের আমলাদেরও ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ঝুঁকি না নেওয়ার একটা প্রবণতা আছে। কোনো কাজ না করে সময়টা কাটানো।

মনজুরুল আহসান: এই একটা অবস্থায় সরকারের বাইরে যাঁরা দেশ, সমাজ, উন্নয়ন নিয়ে ভাবেন তাঁদের কি কিছু করার আছে?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমাদের দুর্ভাগ্য হলো সরকারের কোনো ছোটখাটো কাজের সমালোচনা করলেই তারা মনে করে সরকারের বিরোধিতা করা হচ্ছে। রেহমান সোবহান লিখেছেন, 'আমার সমালোচক আমার বন্ধু।' এই মনোভাবটা সবার থাকলে আরও অনেক কিছু দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন হতো। আমার ধারণা, আমাদের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা মনে করেন 'সবকিছুর সমাধান আমরাই জানি'। এখন তো আমি ভয় পাই। যখন বলেন সুশীল সমাজ, বিশিষ্ট নাগরিক এসব শুনলেই রাজনীতিকদের মধ্যে একধরনের নার্ভাসনেস কাজ করে বলে মনে হয়। তাঁরা সহ্য করতে পারেন না। এমনকি সরকারকে পছন্দ করেন এমন কেউ যখন নিজের নীতিগত অবস্থান থেকে কথা বলেন, তাঁদের মতামতকেও সহ্য করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

মনজুরুল আহসান: ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কোনো জায়গা কি আছে?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমি তো খুব আশাবাদী। বুয়েটে সব মেধাবী তরুণের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। এখনকার তরুণদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস আছে যে সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে দেশটিকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব। তাঁদের এই আত্মবিশ্বাস আমাকে আশাবাদী করে। আরেকটা বিষয়, এখন সারা বিশ্ব স্বীকার করে নিয়েছে, বাংলাদেশে মহিলাদের জাগরণ। এটা অভূতপূর্ব। আমাদের এক তরুণী সাতটি গিরিশৃঙ্গ জয় করেছে, আমাদের ছাত্র মুসা এভারেস্ট জয় করেছে। আত্মবিশ্বাস থাকলে যে লক্ষ্যে পৌঁছা যায়, এটা তার প্রমাণ। ২০২৫ থেকে ২০৩০–এর মধ্যে তারুণ্যের যে ডিভিডেন্ড আমরা পাব, সেটা অকল্পনীয়। গ্রামেও দেখি, নতুন কিছু দেখা, শেখা, নতুন কিছু গ্রহণ করার একটা অভাবনীয় পরিবর্তন। সব বিবেচনা করলে আমি অত্যন্ত আশাবাদী।