বছরে একাধিক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশের উপকূলীয় কৃষি নিয়ে আরও বেশি শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেখানে লবণাক্ততা বাড়ছে।
মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: ভূপ্রাকৃতিক কারণেই দেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বেশি। ঐতিহাসিকভাবে এখানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বেশি হয়। বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের অন্য সময়ে সেখানে লবণাক্ততা অনেক বেশি থাকে। উপকূলে প্রায় চার কোটি মানুষের বাস। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব জমির লবণাক্ততা দিন দিন বাড়ছে। শুধু লবণাক্ততা সমস্যা নয়, এ অঞ্চলে সেচযোগ্য পানিরও সংকট আছে। মূলত এ দুই সমস্যার কারণে এই অঞ্চলে এক লাখ হেক্টরের বেশি জমি শুষ্ক মৌসুমে অনাবাদি থাকছে।
এই পরিস্থিতিতে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষির ভবিষ্যৎ কী?
মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা উপকূলের লবণ-সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনের দিকে নজর দিচ্ছেন। কিন্তু এ ধরনের জাত উদ্ভাবনে অনেক বছর সময় লাগে। বর্তমান লবণাক্ততার মাত্রা মাথায় রেখে জাত উদ্ভাবনের পর দেখা যায়, পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফলে আমরা উপকূলের বর্তমান চাষপদ্ধতি এবং কম লবণাক্ততা থাকে, এমন সময়ে কীভাবে আরেকটি ফসল চাষ করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করি।
উপকূলে অন্য ফসল থাকতে গম কেন?
মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: গত দেড় যুগে দেশে গমের চাহিদা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। ১৮ বছর আগে বাংলাদেশে গমের চাহিদা ছিল ২২ লাখ টন। বর্তমানে তা ৭৫ লাখ টনে পৌঁছেছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে। আগে যাঁরা তিন বেলা ভাত খেতেন, এখন দুই বেলা খান। দেশে গমের উৎপাদন কম হলেও আমরা আমদানি করে বেশির ভাগ চাহিদা পূরণ করি।
কিন্তু গম তো দেশের শীতপ্রধান উত্তরাঞ্চলে বেশি হয়। উপকূলের লবণাক্ত জমিতে কি তা করা সম্ভব?
মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: এটা অনেকেই জানেন না, গমও স্বাভাবিকভাবে কিছুটা লবণসহিষ্ণু। একই সঙ্গে শীতকালীন ফসল। অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর গম উৎপন্ন হয়। মহাদেশটির বড় অংশ তো লবণাক্ত ও উপকূলীয় এলাকা। সেখানে শীতের প্রকোপ বেশি। কিন্তু আমরাও এত দিন মনে করতাম, বাংলাদেশের উপকূলে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে গম চাষ সম্ভব নয়। এটা একদিক দিয়ে সত্য। কারণ, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সেখানে বেশি শীত থাকে, আবার উপকূলে লবণাক্ততাও বেড়ে যায়। ফলে ওই সময় সেখানে গম উৎপাদন হবে কি না, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে সংশয় ছিল। এ জন্য আমরা নতুন এক পদ্ধতিতে উপকূলে গম চাষের উদ্যোগ নিই। ২০১৭ সালে উপকূলে রিলে-পদ্ধতিতে গম চাষ শুরু হয়।
এটা কী ধরনের পদ্ধতি?
মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: উপকূলে গম চাষাবাদের ক্ষেত্রে আমরা নভেম্বর মাসকে বেছে নিয়েছি। সাধারণত ওই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলেও গম চাষ শুরু হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, বর্ষা বিদায় নেওয়ার পরের ওই সময়ে জমিতে তখনো আমন ধান থাকে। তাই আমরা নভেম্বরে পরিণত আমন ধানের জমিতে গমের চারা ছেড়ে দিই। ধান কাটার সময়ে গমের চারা তিন থেকে চার ইঞ্চি বড় হয়ে যায়। ফলে আমন ধান কাটার সময়ে গমের চারার তেমন ক্ষতি হয় না।
আমরা এ পর্যন্ত প্রায় দুই টন গমের বীজ কৃষক পর্যায়ে পাঠিয়েছি। এক কেজি বীজও অবিক্রীত থাকেনি। কৃষকেরা এখন যে গমের চাষ করছেন, তা বীজ হিসেবে বেশ ভালো কাজ করছে। ফলে সরকারিভাবে বীজের সরবরাহ ছাড়াও কৃষকেরা নিজ উদ্যোগেও বীজ উৎপাদন শুরু করেছেন। এই পদ্ধতির ইতিবাচক দিক হলো, এক কৃষকের মাধ্যমে অন্য কৃষকের কাছে বীজ পৌঁছানো। আমি মনে করি, এই উদ্যোগকে সফল করতে হলে সরকারকে উপকূলবিষয়ক একটি জাতীয় কর্মসূচির মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উপকূলের ১৯টি জেলায় তা ছড়িয়ে দিতে হবে। রিলে-পদ্ধতি দেশের অন্যান্য এলাকায় অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বীজ ও কৃষির অন্যান্য উপকরণের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। তার আগে সরকারের উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
আপনাদের ওই গবেষণায় কারা যুক্ত আছেন? কোথায় তা হচ্ছে?
মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: শুষ্ক মৌসুমে এই অনাবাদি জমিকে আবাদের আওতায় আনতে অস্ট্রেলিয়ার এসিআইএআর এবং বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের—কেজিএফ অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া, সিএসআইআরও, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি যৌথ প্রকল্পের আওতায় ওই গবেষণা শুরু করি আমরা। প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উদ্ভাবন করা একটি গমের জাত চাষ শুরু হয়েছে। আরেকটি জাত প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
লবণসহিষ্ণু এই দুটি জাতের সঙ্গে অন্যান্য লবণসহিষ্ণু জাত বারি গম ২৫ ও ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী ও জিঙ্কসমৃদ্ধ জাত বারি গম ৩৩-নিয়েও আমরা কাজ করছি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি জেলা পটুয়াখালী, খুলনা, সাতক্ষীরায় প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। উপকূল অঞ্চলে আমন ধান কাটার পর বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে চাষাবাদ করে শুষ্ক মৌসুমে কৃষকেরা একটি অতিরিক্ত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। এরই মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় আমাদের গবেষণার আওতায় থাকা কৃষকের বাইরেও সাধারণ কৃষকেরা গম চাষ শুরু করেছেন। কিন্তু তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের মাধ্যমে বীজ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
লবণসহিষ্ণু গমের জাত উদ্ভাবনের গবেষণার কাজ কতটুকু এগোল?
মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: গমের আরও ২০টি লাইন নিয়ে ৩টি জেলায় লবণাক্ত জমিতে গবেষণার কাজ করা হয়েছে। গমের এই ২০টি লাইনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো লবণসহিষ্ণু ও জিংকসমৃদ্ধ লাইন। লবণসহিষ্ণু ও জিনবিষয়ক গবেষণার কাজটি অস্ট্রেলিয়ার ল্যাবরেটরিতে বায়োটেকনোলজিক্যাল পদ্ধতিতে করা হয়েছে। কাজটি ল্যাবরেটরিতে করার পর এগুলো নিয়ে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমিতে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আশা করছি, এ বছরের গবেষণাকাজ শেষে লবণসহিষ্ণু গমের আরও লাইন পাওয়া যাবে, যা ভবিষ্যতে অপেক্ষাকৃত বেশি লবণসহিষ্ণু গমের জাত হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
উপকূলের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার সামগ্রিক উদ্যোগের সঙ্গে আপনাদের গম চাষের এই উদ্যোগ কীভাবে যুক্ত করা যায়?
মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: আমরা উপকূলের গম চাষের এলাকা এবং গম চাষের বাইরের জমির লবণাক্ততা পরিমাপ করেছি। ওই পরীক্ষায় দেখা গেছে, গম চাষ হয়েছে এমন জমির লবণাক্ততা অন্য জমির চেয়ে অর্ধেক ছিল। ফলে উপকূলে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা মোকাবিলায় রিলে-পদ্ধতিতে গম চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আমাদের পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়নের জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয় আছে, হাওরের জন্য হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর আছে। উপকূলের ১৯টি জেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও সমস্যা আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদও সেখানে বেশি। তারপরও আমরা এখনো উপকূল উন্নয়নের জন্য স্বতন্ত্র একটি সরকারি সংস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। এ ধরনের সংস্থা থাকলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গম চাষসহ অন্যান্য উদ্যোগকে সমন্বিতভাবে করা সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে উপকূলীয় ভূমি উন্নয়নে আলাদা কমিশন করার কথা বিবেচনা করে দেখতে পারে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মৃন্ময় গুহ নিয়োগী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।