২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বিশেষ সাক্ষাৎকার: মুস্তফা কামাল মুজেরী

সবখানেই গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় আমরা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছি

ড. মুস্তফা কামাল মুজেরী গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) নির্বাহী পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদের দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, পরিকল্পনা কমিশনের বিশেষজ্ঞ ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির হয়ে কম্বোডিয়া সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ব্যাংক খাত, খেলাপি ঋণ, ডলার–সংকট, মূল্যস্ফীতি, ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগ দেওয়াসহ অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

মুস্তফা কামাল মুজেরী
প্রশ্ন:

ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ ৯ থেকে ১২ বছর করা হলো। এর আগে ২০১৮ সালে ৬ থেকে ৯ বছর করা হয়েছিল। গ্রুপের এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে। আগে এই সুযোগ ছিল না। এর প্রভাব কী হবে?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: আমাদের ব্যাংকিং খাত ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং খাতের পুঞ্জীভূত সংকটের বহিঃপ্রকাশ বেশ কিছুদিন থেকে আমরা দেখছি। অনেকগুলো ব্যাংক ভালোভাবে চলছিল, এখন সেগুলোতেও নানা ধরনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতার জন্য ইদানীং ব্যাংক পরিচালকদের ভূমিকার বিষয়টিও লক্ষ করা যাচ্ছে। ব্যাংকিং কাঠামোকে আমরা যদি সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর করে তুলতে চাই, তাহলে এখন যেসব দুর্বলতা আছে, সেগুলো বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত জরুরি। এ প্রেক্ষাপটে ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং গ্রুপের এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বর্তমান দুর্বলতাগুলো কাটাতে কোনো ভূমিকা রাখবে না। ব্যাংক খাতের আজকের এই পরিস্থিতির জন্য পরিচালকদের প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের কঠোর বার্তা দেওয়া দরকার ছিল। সেখানে এ ধরনের পদক্ষেপ উল্টো বার্তা দেবে।

এখানে গোষ্ঠীস্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা প্রকটভাবে দেখা গেল। এ ধরনের সিদ্ধান্ত জনস্বার্থ বা জাতীয় স্বার্থের পুরোপুরি পরিপন্থী। যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানো, সেটি খুব প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়া। জাতীয় সংসদে যখন বিলটা প্রথম উত্থাপন করা হয়, সেখানে পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি ছিল না। সংসদীয় কমিটিও এ ব্যাপারে সংশোধনী দেয়নি। কিন্তু একজন সংসদ সদস্যের সংশোধনী প্রস্তাবে আক্ষরিকভাবেই কোনো আলোচনা ছাড়াই জাতীয় সংসদে সেটা পাস হয়ে গেছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের মতো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইনের সংশোধনী যেভাবে পাস হয়েছে, সেটাকে খুব একটা গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া বলা যায় না।

ঋণখেলাপিরা যখন ক্ষমতার অংশীদার হয়ে যান, তখন এ দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসা খুবই দুষ্কর। আমরা সবখানেই গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের জাতির জন্য, আমাদের উন্নয়নের জন্য, এই গোষ্ঠীস্বার্থ দীর্ঘকালীন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে
প্রশ্ন:

এক বছরের বেশি সময় ধরে ডলার–সংকট চলছে। অনেক ব্যাংক, বিশেষত ইসলামি ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে ভুগছে। ডলারের সঙ্গে টাকারও সংকট। কেন সংকট দীর্ঘ হচ্ছে?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: আজকের ডলার–সংকট, তারল্যসংকট কিন্তু হঠাৎ তৈরি হয়নি। সমস্যাটি যখন স্বল্প ছিল, তখন এখানে খুব একটা সুদৃষ্টি দেওয়া হয়নি; বরং লালন–পালন করা হয়েছে। সমস্যাটি এখন যখন বিস্ফোরিত হয়েছে, তখন সেটা অনেকটাই আমাদের আওতার বাইরে চলে গেছে। ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটা শিগগিরই কমে আসবে বলে মনে হয় না। আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। শুধু খাদ্যপণ্য নয়, শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি—সবকিছুই আমদানি করতে হয়। এই আমদানিনির্ভরতা কোনোভাবে কমিয়ে আনা গেলে সংকট হয়তো কিছুটা লাঘব হতে পারত; কিন্তু জ্বালানি, শিল্পের কাঁচামাল ও খাদ্যপণ্যে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনা দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। এ কারণে আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের চাহিদা আশু কমিয়ে আনার সম্ভাবনা নেই।

ডলার সরবরাহের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। আমাদের ডলারপ্রাপ্তির বড় দুটি উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়। এ দুটোর ক্ষেত্রে হঠাৎ উল্লম্ফন হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। রপ্তানি আয় বাড়াতে হলে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে, বাজার বাড়াতে হবে। প্রবাসী আয় যদিও ক্রমাগত বাড়ছে, কিন্তু নানা টানাপোড়েনের কারণে সেটা খুব দ্রুত বাড়ার সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে দেখি না। সবকিছু মিলিয়ে ডলার–সংকট বা বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আমাদের আরও বেশ কিছুদিন ভোগাবে। আমরা অনেকগুলো মেগা প্রকল্প করেছি। সেগুলোর কিস্তি শোধ করতে হচ্ছে। এটাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। আইএমএফ বা অন্য কোনো সংস্থার ঋণ এ ক্ষেত্রে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু সেগুলো সমস্যার সমাধান নয়। আমাদের নিজস্ব শক্তির ওপরই দাঁড়াতে হবে। চাহিদা ও সরবরাহ দুদিকেই তাকাতে হবে, যাতে আমরা আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল হতে পারি।

ব্যাংকিং খাতের তারল্যসংকট বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির যে টানাপোড়েন, তার বহিঃপ্রকাশ দেখছি ব্যাংকিং খাতের তারল্যসংকটের মধ্যে। এটা থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার।

প্রশ্ন:

খেলাপি ঋণ বাড়ছে, এর মধ্যে আবার ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়া হলো। অনেকেই বলছেন, নির্বাচনের আগে এটা ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ সুবিধা।

মুস্তফা কামাল মুজেরী: ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময়ে তাদের উদ্দেশ্যমূলক অভিসন্ধি থেকে ঋণখেলাপিদের ছাড় দিয়েছে। ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বড় ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে আমরা সব সময় ঋণের ভগ্নাংশ শোধ করার সুবিধা দিয়ে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি। খেলাপি ঋণের যে সংস্কৃতি এখানে গড়ে উঠেছে, সেটা ইচ্ছাকৃত। অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার নামে ঢালাওভাবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের যতই সুবিধা দেওয়া হোক না কেন, তাঁদের ইচ্ছাটা যত দিন যাবে, ততই প্রবল হবে।

কারণ, তাঁদের কাছে মনে হবে, আমরা যত ঋণখেলাপি হব, তত বেশি সুবিধা আমরা পাব। নির্বাচন হোক কিংবা অন্য কোনো প্রেক্ষাপট, খেলাপি ঋণ এখন একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে চলে গেছে। পুরোপুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া খেলাপি ঋণের খপ্পর থেকে আমরা বের হতে পারব না। খেলাপি ঋণের চক্কর থেকে বের হতে না পারার কারণ গোষ্ঠীস্বার্থ। ঋণখেলাপিরা যখন ক্ষমতার অংশীদার হয়ে যান, তখন এ দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসা খুবই দুষ্কর। আমরা সবখানেই গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের জাতির জন্য, আমাদের উন্নয়নের জন্য এই গোষ্ঠীস্বার্থ দীর্ঘকালীন মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে।

প্রশ্ন:

মুডি’স দেশের রেটিং কমিয়ে দিয়েছে। এরপর কয়েকটি ব্যাংকের রেটিং কমিয়ে দিয়েছে ঋণমান নির্ণয় করা সংস্থাটি। ডলার–সংকটের মধ্যে এই রেটিং কমানোর প্রভাব কী হতে পারে?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: মুডি’সসহ অন্যান্য রেটিং সংস্থার রেটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লেনদেনের শর্তাবলি নির্ধারিত হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিমালিকানাধীন খাত, মুদ্রাবাজার, পুঁজিবাজারের যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে, তারা এই রেটিংয়ের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের অর্থনীতির শক্তি-সামর্থ্যটা বুঝতে পারে। ঋণ প্রদান থেকে শুরু করে এলসি খোলা—এর ওপর ভিত্তি করেই করা হয়।

আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতা—এসব বিবেচনায় মুডি’স আমাদের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা যখন লেনদেনে যাব, তখন আমাদের ওপর তাদের আস্থাটা কমে আসবে। লেনদেন, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে শর্তগুলো আগের তুলনায় কঠোর হবে। মুডি’স ঋণমান কমিয়ে দেওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোকে ইতিমধ্যে এলসি খোলার ক্ষেত্রে বিপত্তিতে পড়তে হচ্ছে।

প্রশ্ন:

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, মুডি’স ঋণমান কমালেও বাংলাদেশের জন্য কিছু যায় আসে না। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: আমাদের আর্থিক খাত কতটা শক্ত তার একটা প্রমাণ হিসেবে কাজ করে আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী সংস্থাগুলোর রেটিংটা। আমরা যখন প্রাইভেট পুঁজিবাজার থেকে ঋণ নিই কিংবা লেনদেন করি, সেটা কিন্তু এই রেটিংয়ের ভিত্তিতেই করা হয়। ফলে কিছু যায় আসে না বললেই তো আর কিছু যায় আসবে না— এমনটা নয়। আমরা তো বৈশ্বিক আর্থিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন নই।

প্রশ্ন:

এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। মূল্যস্ফীতিকে নীরব ঘাতক বলা হয়। মূল্যস্ফীতি কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি কেন?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের এখানকার মূল্যস্ফীতির পার্থক্য আছে। উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি ব্যবহার করে। মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফল হয়। কিন্তু আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতিটা বহুমাত্রিক। এখানে শুধু মুদ্রা সরবরাহ বেশি হলেই মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, এমনটা নয়।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কাঁচামাল ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে একটা ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু অনেক দিন ধরেই বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম নিম্নমুখী। ভারত তাদের দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি এখনো ৯-এর ওপরে। আমার কাছে মনে হয়, নীতির সমন্বয় না থাকার কারণে আমরা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছি।

কয়েক দিন আগে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে ও নীতি সুদহার বাড়িয়ে এবং সুদের হারের ওপর যে প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেটা কিছুটা শিথিল করে মূল্যস্ফীতি কমাতে পদক্ষেপ নিতে দেখছি। কিন্তু আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতির ভূমিকা অনেকটাই সংকীর্ণ। কিন্তু আমাদের রাজস্ব নীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নয়। আমরা এবার রেকর্ড পরিমাণ বড় বাজেট দিয়েছি। বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ আমাদের নিতে হবে। এটি ঋণনির্ভর বাজেট। ফলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ রাজস্ব নীতি আমরা দেখছি না। মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্ব নীতির সমন্বয়হীনতা মূল্যস্ফীতিকে লাগামছাড়া করে রেখেছে।

প্রশ্ন:

আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত অকার্যকর। সবখানেই সিন্ডিকেট। বাজারের এই দুর্বলতাও তো মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা মূল্যস্ফীতিকে আরও প্রকট করেছে। কয়েক দিন আগে পেঁয়াজের দাম হঠাৎই আকাশচুম্বী হয়ে গেল। এভাবে লাগামছাড়া দাম বাড়া উৎপাদন কিংবা বাজারের পরিসংখ্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরকার বাধ্য হয়ে আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর পেঁয়াজের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এল। এটা আমাদের বাজারব্যবস্থার বিচ্যুতির দৃষ্টান্ত। এর মানে বাজারটা ঠিকমতো কাজ করছে না।

এর ফলে কিছু ব্যক্তি বাজারে কারসাজি করতে সক্ষম হয়। শুধু পেঁয়াজ নয়, সব ক্ষেত্রেই কিছু মানুষ বাজারব্যবস্থার বিচ্যুতিকে কারসাজি করার সুযোগ হিসেবে নেন। এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি ক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। বাজারের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অপসারণ ও গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ মুক্ত করা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে গেলে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা তিনটি ক্ষেত্রেই সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ খুব বেশি কাজে আসবে না।

প্রশ্ন:

মূল্যস্ফীতি কমাতে এবার বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমানোর নীতি নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বাড়বে সরকারি খাতে ঋণ। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব কী হতে পারে?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: সরকারি খাত যদি বেশি ঋণ নেয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি খাতে ঋণের ভাগটা ছোট হয়ে যাবে। আমাদের উৎপাদন থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান—সবকিছুই বেসরকারি খাতনির্ভর। তারল্যসংকট, ব্যাংক ব্যবস্থার কাঠামোর দুর্বলতা—এসব কারণে আমাদের ব্যাংকগুলোর ঋণপ্রবাহটা সীমিত হয়ে গেছে। বেসরকারি খাতে যদি ঋণপ্রবাহ কমে যায় বা তারা যদি প্রয়োজনমতো ঋণ নিতে না পারে, তাহলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, কর্মসংস্থানসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।

আমাদের পুঁজিবাজার শক্তিশালী না হওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের সিংহভাগ আছে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। সরকারি খাতের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় তার ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট বা বেসরকারি খাতে কোনো ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে কি না, তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

প্রশ্ন:

ঋণের সুদহার গণনার ৯ শতাংশ সীমা থেকে তিন বছর পর বের হয়ে এল বাংলাদেশ। নতুন সুদ গণনা হবে ট্রেজারি বিলের সঙ্গে। এটা কতটা প্রভাব পড়বে?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: সুদহার গণনার সীমা থেকে আমরা পুরোপুরি বের হয়ে আসিনি, কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। এটা একদিক থেকে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদের হার পুরোপুরি তুলে দেওয়া হলে ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে। ব্যবসা–বাণিজ্য বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদের হার খুব বড় ফ্যাক্টর নয়, এ ক্ষেত্রে আরও বড় ফ্যাক্টর আছে। আমাদের টেকসই উন্নয়নের জন্যই বাজারভিত্তিক সুদের হারের দিকে যাওয়া প্রয়োজন। চূড়ান্তভাবে আমাদের সেদিকেই যেতে হবে।

প্রশ্ন:

ব্যাংক খাত ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। আপনার অভিমত কী?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: ব্যাংক খাতই আমাদের দেশে প্রধান আর্থিক খাত। ব্যাংক খাত সামগ্রিকভাবে আমাদের উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি যত বড় হবে, ততই বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে এটি ইন্টেগ্রেটেড (অংশভুক্ত) হতে থাকবে। আমাদের ব্যাংক খাতে বর্তমানে যে দুর্বলতা আছে, সেটা নিয়ে বৈশ্বিক আর্থিক বাজারের সঙ্গে অংশভুক্ত হতে গেলে একটা দুর্যোগ বয়ে আনবে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাত শক্তিশালী হচ্ছে। সেখানে আমাদের ব্যাংক খাত নানা রকম ব্যাধিতে ভুগছে।

এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতকে ব্যাধিমুক্ত করতে শক্তিশালী, বিচক্ষণ ও ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের ব্যাংক খাতে নানা সময়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেগুলো বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ। একেক সময় একেক ধরনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তাতে করে অংশীজনদের কাছে ধারাবাহিক কোনো বার্তা যাচ্ছে না। আমরা কী চাই, কোথায় যেতে চাই, সেটা কারও কাছে পরিষ্কার নয়। এই ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগটা নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল।

প্রশ্ন:

ব্রিকসে যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ। এর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের দিকগুলো কী?

মুস্তফা কামাল মুজেরী: ব্রিকস একটি নতুন উদ্যোগ, এখনো এটি কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বর্তমানে বৈশ্বিক যে আর্থিক ব্যবস্থা আছে, তার মধ্যে ব্রিকসকে বিকল্প একটি ব্যবস্থা হিসেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এ কাজটা দুরূহ। কেননা, প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ব্রিকসের দেশগুলো এখনো একটি বড় ও শক্তিশালী গ্রুপ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেনি। আমাদের প্রয়োজনের খুব কম অংশই ব্রিকস মেটাতে পারবে।

কাজেই ব্রিকস থেকে আমরা কী চাই, কতটা চাই, সেটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করতে হবে। ব্রিকসে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে বার্তাটা কী যাচ্ছে, সেটা বিবেচনা করতে হবে। এখানে মূল প্রশ্নটি হলো বিদ্যমান যে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা আছে, সেটাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য আমরা ব্রিকসে যোগ দিচ্ছি, নাকি পরিপূরক হিসেবে যোগ দিচ্ছি। প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়ে ব্রিকসে যুক্ত হলে সেটা ভুল হবে।

প্রশ্ন:

আপনাকে ধন্যবাদ।

মুস্তফা কামাল মুজেরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।